বাংলাদেশ, অর্থনীতি

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে সংকটের মুখে স্বল্প আয়ের দেশগুলো!

সিরাজুর রহমান

ডিবিসি নিউজ

মঙ্গলবার ১০ই ডিসেম্বর ২০২৪ ০৫:৩৬:১২ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

একটি দেশের দীর্ঘ মেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সক্ষমতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে শুধু জিডিপির আকার কিংবা মাথাপিছু আয় বিবেচনা করলে দেশটির প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কখনোই বাস্তব ধারণা পাওয়া যাবে না।

বিশেষ করে স্বল্প আয়ের এবং প্রাথমিক উন্নয়নশীল পর্যায়ের দেশগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বৈদেশিক ঋণ ঠিক কোন পর্যায়ে রয়েছে তা কিন্তু গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

 

বিশেষ করে একটি দেশের দীর্ঘ মেয়াদে বৈদেশিক (আমদানি ও রপ্তানি) বাণিজ্য ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকলে তাকে কোনো অবস্থাতেই একটি টেকসই, শক্তিশালী এবং ইতিবাচক ধারার দেশ হিসেবে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ থাকে না। সারা বিশ্বে বর্তমানে আমেরিকার নিজস্ব মুদ্রা ডলারের গ্রহণ যোগ্যতা কিছুটা হ্রাস পেলেও বাস্তবে বিশ্বের সকল দেশই কিন্তু এখনো পর্যন্ত নিরাপদ রিজার্ভের জন্য মূল কারেন্সি হিসেবে ডলারকেই বেছে নিতে হয়।

 

প্রথমে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, চলমান অস্থিরতার মধ্যেও ইতিবাচক রেমিটেন্স আয় বৃদ্ধি এবং সার্বিক আমদানি ব্যয় হ্রাস পাওয়ার কারণে দেশের গ্রস ফরেক্স রিজার্ভ এখনো পর্যন্ত ২০ বিলিয়ন ডলারের অনেকটাই উপরে রয়েছে।

 

চলতি ২০২৪ সালের ২১শে নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসারে, বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ১৮.৪৯৪ বিলিয়ন ডলার এবং গ্রস রিজার্ভ ২৪.২৭ বিলিয়ন ডলার। যেখানে গত সেপ্টেম্বর মাস শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯.৮৬২ বিলিয়ন ডলার এবং গ্রোস রিজার্ভ ছিল ২৪.৮৬৩ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৪ সালের ৭ই মার্চ এর হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতির পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে (বিপিএম-৬) ২১.১৫ বিলিয়ন ডলার হয়। তবে ১৭ কোটি বিশাল আকারের জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমপক্ষে ৫৫ বিলিয়ন ডলার বা তারও অধিক থাকা উচিত। তবে সেই লক্ষ্য আমাদের কিন্তু কোন দিনই অর্জিত হয়নি।

 

এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতের ফরেন ট্রেড এন্ড ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট ডাটাবেজ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা এবং দীর্ঘ মেয়াদি ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যেও দেশটি তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিবাচকভাবে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।

 

ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, গত ২৯শে নভেম্বর দেশটির হাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬৫৮.০৯ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি ২০২৪ সালের ১লা মার্চে ভারতের এই রিজার্ভ ছিল ৬২৫.৬৩ বিলিয়ন ডলার।

 

তবে বিশ্বের শীর্ষ প্রথম স্থানীয় একক কোন দেশ হিসেবে চীনের কাছে গত ৩১শে অক্টোবরের হিসেব অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩.৩৮ ট্রিলিয়ন ডলারের ফরেক্স রিজার্ভ মজুত ছিল। তাছাড়া চলতি ২০২৪ সালের নভেম্বরের হিসেব অনুযায়ী বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শীর্ষ স্থানীয় ফরেক্স রিজার্ভ অর্জনকারী দেশ হিসেবে জাপানের কাছে ১.১৬৪ ট্রিলিয়ন ডলার এবং সুইজারল্যান্ডের কাছে ৮৬৪.৫২ বিলিয়ন ডলারের ফরেক্স রিজার্ভ মজুত ছিল। আর এদিক দিয়ে বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ স্থানীয় রিজার্ভ অর্জনকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ভারত।

 

এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত অন্যান্য  দেশগুলোর মধ্যে বিগত এক দশক ব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে থাকা পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আইএমএফ এর দেয়া বেল আউট ঋণ প্যাকেজ এবং চীন কিংবা সৌদি আরবের মতো দেশের ঋণ ও দেনার উপর ভর করে কোন রকমে টিকে রয়েছে। সেন্ট্রাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের দেয়া হালনাগাদ তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ২৯শে নভেম্বর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিট ১২.০৩৮ বিলিয়ন ডলারের ফরেক্স রিজার্ভ মজুত ছিল।

 

তবে করোনা মহামারির সময় গত ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চরম মাত্রায় অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ দক্ষতার সাথেই তাদের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠছে। বিশেষ করে গত ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশটি। একাধিক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মধ্যেও চলতি ২০২৪ সালের অক্টোবর মাস শেষে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬.৪২৫ বিলিয়ন ডলার। যেখানে গত ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে শ্রীলংকার হাতে মাত্র ১.৮৯৬ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল।

 

উইকিপিডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে চলতি ২০২৪ সালের একই সময়ে ব্যবহার যোগ্য অবস্থায় আফগানিস্তানের ৪৩৩ মিলিয়ন ডলার, নেপালের ১৮.৪ বিলিয়ন ডলার, ভুটানের ৯২৭ মিলিয়ন ডলার এবং মালদ্বীপের ৫৮৮ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (স্বর্ণের মজুতসহ) ছিল। তাই পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বল্প আয়ের দেশগুলোকে টেকসই অর্থনৈতিক  উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বজায় রাখার স্বার্থে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহার এবং সংরক্ষণে অবশ্যই আরও সচেতন হতে হবে।

তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক, সেন্ট্রাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, ইউকিপিডিয়া, সিনহুয়া নিউজ, রয়টার্স।


শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ

 

ডিবিসি/ এইচএপি

আরও পড়ুন