পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার ধামোর ইউনিয়নের জুগিকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্লিপের বরাদ্দের ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ের হিসেব নিয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ও সভাপতির দ্বন্দ্বে গত ৪ দিন ধরে বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কোনো শিক্ষার্থীও আসছে না বিদ্যালয়টিতে। ফলে অলস সময় কাটাচ্ছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।
সরকারি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ করে দেওয়াসহ কয়েকটি অভিযোগে সভাপতিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে (গত ২৬ জুলাই) আটোয়ারী থানায় একটি এজহার দায়েরসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেছেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষিকা আনজুমান আরা বেগম। তবে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কর্তারা বলছেন, দ্রুতই পাঠদান চালু করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
গেল কয়েকদিন ধরে বিদ্যালয়টিতে গিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য, অভিভাবক সদস্যসহ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা আঞ্জুমান আরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে নিজের মতো বিদ্যালয় পরিচালনা করেন। বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসেব দেন না বিদ্যালয়ের পরিচালনার কমিটির সদস্যদেরও। নেই জবাবদিহিতা। বিদ্যালয়টি নিয়মিত পরিদর্শনে আসেন না ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাও।
এদিকে বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে রয়েছে দু’টি বিছানা। শিক্ষার্থীদের পুরো সময় পাঠদান না করিয়ে বিদ্যালয়ের ওই কক্ষে রাখা দু’টি বিছানায় সন্তানদের নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন শিক্ষিকারা। প্রধান শিক্ষিকাকে হাতে রাখতে নানা উপঢৌকনও দেন অন্য শিক্ষিকারা। ফলে বিদ্যালয়ে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বিদ্যালয়ে কাগজে কলমে ১০১ জন শিক্ষার্থী থাকলেও প্রতিদিন আসে ১৬ থেকে ২০ জন। প্রধান শিক্ষিকার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বিদ্যালয়ে তেমন পড়াশোনা হয় না। তার সঙ্গে যোগসাজসে রয়েছেন সহ-শিক্ষিকা সামছুন নেহার। তাই এই দু’জনকে অপসারণ করে বিদ্যালয়ে পুরুষ শিক্ষক পদায়নেরও দাবি তাদের।
জুগিকাটা এলাকার ফুলেশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমার সন্তান চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। সে এখনও দেখে দেখে পড়তে পারে না। বিদ্যালয়টিতে পড়াশোনার মান খুবই খারাপ। অনেক বাচ্চা এখান থেকে বের হয়ে অন্যত্র গিয়ে ভর্তি হয়েছে। কয়েকদিন ধরে বিদ্যালয়টিতে পাঠদান বন্ধ। তাই আমার বাচ্চাও বিদ্যালয়ে আসছে না।’
একই এলাকার পাতিলি রাণী বলেন, ‘বিদ্যালয়ের সভাপতি আমাদের বাড়ি গিয়ে বলে এসেছেন এ সমস্যার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত যেন বাচ্চাকে স্কুলে না পাঠাই। তাই বাচ্চা বিদ্যালয়ে যাচ্ছে না। আমরা তো বাচ্চাকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চাই। জানিনা কবে সমস্যার সমাধান হবে।’
একই এলাকার আনন্দ চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘জুগিকাটা বিদ্যালয়ে কোনো পড়াশোনা হয় না। শিক্ষিকারা স্কুলের একটি রুমে বিছানা পেতেছেন, সেখানে তাদের বাচ্চার সঙ্গে তারাও ঘুমান। প্রধান শিক্ষিকা ও সহকারী শিক্ষিকা সামসুন নেহারকে বিদ্যালয় থেকে অন্যত্র বদলি না করা পর্যন্ত আমরা আমাদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাব না। প্রয়োজনে বাড়িতে পড়াব, না হয় অন্য স্কুলে ভর্তি করে দেব।’
বিদ্যালয়ের সভাপতি অনিল চন্দ্র পাল বলেন, ‘প্রধান শিক্ষিকা আঞ্জুমান আরা দীর্ঘদিন ধরে এখানে আছেন। এটা যে একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তিনি তা মনে করেন না। নিজের মতো চালাতে চান। বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছ হিসেব দেন না। অভিভাবকদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেন তিনি। এক সময় শিশুদের পদচারণায় মুখর থাকা বিদ্যালয়টি এখন শিক্ষার্থী সঙ্কটে। কাগজে-কলমে শতাধিক শিক্ষার্থী থাকলেও প্রতিদিন ২০ জনও উপস্থিত থাকে না। যারা আসছে, তারা পড়াশোনায় অনেক পিছিয়ে। এজন্য অভিভাবকরা সন্তানদের অন্যত্র ভর্তি করাচ্ছেন। এসব শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়মুখী করতে কোনো উদ্যোগও নেই তার।’
এছাড়া বিদ্যালয়ে তিন ধাপে স্লিপের ৯০ হাজার টাকার মধ্যে ৫০ হাজার টাকার হিসেব দেখাতে পারলেও বাকি ৪০ হাজার টাকার কোনো হিসেব নেই প্রধান শিক্ষিকার কাছে। যা পুরোটাই তিনি আত্মসাৎ করেছেন। তিনি আমাকেসহ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির কাউকে হিসেব তো দেননি যেন তোয়াক্কাই করছেন না কাউকে। বিদ্যালয়ে কোনো সভারও আয়োজন করেন না।’
তবে প্রধান শিক্ষিকা আনজুমান আরা বেগম বলেন, ‘সভাপতি আমার কাছে ৪ হাজার টাকা চেয়েছেন। কী করবেন, তা জানাননি। আমি টাকা না দেওয়ায় তিনি এসব করছেন। এখন সভাপতির সঙ্গে স্থানীয়রা ও অভিভাবকেরা এক হয়ে বাচ্চাদের পাঠাচ্ছে না। আমি আমার শিক্ষকদেরসহ বাচ্চাদের বাসায় গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে উঠান বৈঠক করেছি। তারা বাচ্চাদের আসতে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু তাদের ভয় দেখানো হয়েছে যে যেকোনো সময় স্কুলে মারামারি হতে পারে, তাই বাচ্চাদের যেন স্কুলে পাঠানো না হয়। ফলে পাঠদান সাময়িক বন্ধ রয়েছে। সভাপতি আমার কাছে টাকা নিতে না পেরে স্থানীয় কিছু মানুষকে নিয়ে আমার ও এক শিক্ষকের বদলি দাবি করছেন। যেটা হাস্যকর। আমার কাছে পরিপূর্ণ টাকার হিসেব আছে। কোন খাতে কত টাকা ব্যয় আমি তাদের দেখিয়েছি। আর পাশের কক্ষে থাকা বিছানা আমাদের নিরাপত্তাপ্রহরীর। দু’জন শিক্ষিকার সন্তানকে মাঝে মাঝে সেখানে শোয়ান তারা। আমি এ বিষয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে সভাপতিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে থানায় এজহারসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছি। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে আশা করি।’
এ বিষয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাসুদ হাসান বলেন, ‘আমরা বিদ্যালয় চালুর ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। আশা করি তাড়াতাড়ি সমস্যার সমাধান হবে।
এদিকে গত মঙ্গলবার দুপুরে বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য, অভিভাবক সদস্য, স্থানীয় সুশীল সমাজ ও শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষিকা ও এক সহকারী শিক্ষিকার বদলি দাবি করে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
ডিবিসি/আরপিকে