ঝিনুকের জেলা ঝিনাইদহে শুরু হয়েছে মুক্তার চাষ। পুকুরে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ হচ্ছে মুক্তা। মুক্তার ঝলকে বেকার যুবকদের মাঝে দেখা দিয়েছে আশার আলো।
প্রাচীনকালে বর্তমান ঝিনাইদহের উত্তর পশ্চিম দিকে নবগঙ্গাঁ নদীর ধারে ঝিনুক কুড়ানো শ্রমিকের বসতি গড়ে ওঠে বলে জনশ্রতি আছে। সে সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে ব্যবসায়ীরা ঝিনুকের মুক্তা সংগ্রহের জন্যে এখানে ঝিনুক কিনতে আসতো। সে সময় ঝিনুক প্রাপ্তির এই স্থানটিকে ঝিনুকদহ বলা হতো।
ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহের মাধ্যমে এবং ঝিনুক পুড়িয়ে চুন তৈরী করে তা বিক্রি করে মানুষ অর্থ উপার্জন করতো। অনেকের মতে ঝিনুককে আঞ্চলিক ভাষায় ঝিনেই, ঝিনাই এবং দহ অর্থ বড় জলাশয় ও ফার্সি ভাষায় দহ বলতে গ্রামকে বুঝানো হতো। সেই অর্থে ঝিনুকদহ বলতে ঝিনুকের জলাশয় অথবা ঝিনুকের গ্রাম বুঝাতো। আর এই ঝিনুক এবং দহ থেকেই ঝিনুকদহ বা ঝিনেইদহ, যা- রুপান্তরিত হয়ে আজকের ঝিনাইদহ নামকরণ হয়েছে।
কিন্তু কালের বিবর্তনে ঝিনুকের জেলা ঝিনাইদহে প্রাকৃতিকভাবে আর তেমন মেলে না ঝিনুক বা প্রাকৃতিক মুক্ত। তবে অসংখ্য খাল-বিল আর জলাশয়ে সামান্য ঝিনুক এখনো রয়ে গেছে। এই ঝিনুককে সঙ্গী করে শিক্ষিত বেকার যুবকেরা নিয়েছে নতুন উদ্যোগ। সে উদ্যোগে আশার আলো ছড়াচ্ছে মুক্তর ঝলক।
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার মামুনশিয়া গ্রামের আক্কাস আলী দেলোয়ার হোসাইন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন। এরপর খুঁজে বেড়িয়েছে চাকরি। কিন্তু প্রত্যাশা মতো মিলছিলো না। এ অবস্থায় একদিন মোবাইলে ইউটিউবে ঢুকে দেখতে পান স্বল্পপুঁজিতে বাড়িতে বসেই স্বাদু পানিতে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তা চাষ সম্ভব এবং তা খুবই লাভজনক। প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ। কালবিলম্ব না করে ময়মনসিংহ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউটে মুক্ত চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নেন দেলোয়ার হোসাইন। শিখে নেয় ঝিনুকে নিউক্লিয়াস তৈরির প্রক্রিয়া এবং তা কিভাবে ঝিনুকে সার্জারি করতে হয়। এরপর তিনি চলে আসেন গ্রামে, নেমে পড়েন পুকুরে মুক্তা চাষের প্রক্রিয়াতে।
দেলোয়ার তার নিজের ২০ শতকের একটি পুকুরে আশপাশ থেকে দেশিয় ঝিনুক সংগ্রহ করেন। নিউক্লিয়াস ঝিনুকে সার্জারি করে পানির ওপরের অংশে নেট ঝুলিয়ে সেখানে ছেড়ে দেন সার্জারি করা ঝিনুক। ৮ থেকে ১২ মাসের মাথায় ঝুলন্ত প্রত্যেক ঝিনুকে দেখা মেলে মুক্তার। এই ঝিনুকগুলো জুপ্লাংটন, ফাইটোপ্লাংটনসহ জৈব খাবার খেয়ে থাকে। দেলোয়ার তার পুকুরে ৩ ধরনের মুক্তার চাষ করছেন। ইমেজ মুক্তা, নিউক্লিয়াস ও রাইচ মুক্তা। বর্তমানে ইমেজ মুক্তা বেশি বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন অনলাইনে আর ভারতে এই মুক্ত বিক্রি হচ্ছে বেশি বলে জানান দেলোয়ার।
২০১৭ সালে মাত্র ২৫ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে দেলোয়ার এভাবে মুক্ত চাষ শুরু করেন। ১ পিস মুক্তা ১ হাজার থেকে ১২শ' টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়। উদ্যোক্তা দেলোয়ার এ পর্যন্ত ৪ হাজার পিসের ওপরে মোট ৫ লক্ষাধিক টাকার মুক্ত বিক্রি করেছেন। শুরুর দিকে অর্থাৎ গত ৩ বছরের মুক্তা চাষের পরিমাণ কম কম করলেও এবার সর্বোচ্চ ৪ হাজার পিস ঝিনুক মুক্তার চাষ করছেন। বাড়িয়েছেন পুকুরের সংখ্যাও। ২০ শতকের মুক্তার পুকুরের পাশাপাশি ৩০ শতকের আরেকটি পুকুর বানিয়েছেন, সেখানে শুধুই ঝিনুকের চাষ করছেন। বর্তমানে তার খামারে ২ জন কর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে ১ জন ম্যানেজার ও ১ জন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।
দেলোয়ারের খামারে কর্মরত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আহমেদ জানান, খুব সহজেই যে কেউ ইচ্ছা করলে স্বল্প পুঁজিতে তাদের পুকুরে মুক্তা চাষ করতে পারে, এতে কোন ঝুঁকি নেই। মাছ চাষের পাশাপাশি ঝিনুকে মুক্তা চাষ একটা বাড়তি আয়।
তিনি আরো জানান, যে পুকুরে ঝিনুক বা মুক্তা চাষ করা হয়, সে পুকুরের পানিও স্বচ্ছ হয় কারণ ঝিনুক অস্বচ্ছ পানি ও ময়লা খেয়ে ফেলে। ঝিনুক সার্জারি করে ঝিনুকের মেন্টাল টিস্যুতে নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপন করে নেট বা মিষ্টির কার্টনে সুতা দিয়ে পানির ২ থেকে ৩ ফুট গভীরে ঝুলিয়ে দিতে হয়।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নাজমুল হোসেন জানান, মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট মুক্ত চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় ২০১২ সালে। এর মাধ্যমে চাষিদের মুক্ত চাষে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সব ধরনের মুক্তা অপারেশন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সবচেয়ে সহজ ডিজাইন মুক্ত চাষ।
কোটচাঁদপুরের উদ্যোক্তা দেলোয়ার হোসেন জানান, যখন মুক্তা চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন এলাকার অনেকেই পাগল বলে আখ্যা দেয়, তারা বিষ্ময় প্রকাশ করে বলে এখানে এসব পুকুরে কিভাবে মুক্তা হবে। এতে জেদ আরো বেশি চেপে যায়। প্রমাণ করতে হবে মুক্তা চাষ সম্ভব। তাই জেদ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে যান ময়মনসিংহ মৎস গবেষণা ইনিস্টিটিউটে।
দেলোয়ার আরো জানান, তার খামারে ভালো মুক্তা হচ্ছে, দেশে-বিদেশে মুক্তার ভাল বাজার রয়েছে, বিদেশে রপ্তানি সম্ভব। সরকার যদি তার প্রকল্পে লোন সহায়তা, এডিবির বরাদ্দ দেয় তাহলে বৃহৎ আকারে মুক্তার চাষ ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব বলে তিনি জানান।
কোটচাঁদপুর উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা জোয়াদুর রসুল জানান, দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে এই জাতীয় উদ্যোগ প্রশংসনীয়। দেলোয়ারের দেখাদেখি বিভিন্ন উপজেলার মানুষ মৎস্য অফিসে মুক্তা চাষ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। ১ পিস মুক্তা চাষে খরচ সর্বোচ্চ ৫০ টাকা আর বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকার বেশি। বেকার যুবকরা সয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে। মৎ্যি অধিদপ্তÍরের পক্ষ থেকে এআইএফটু প্রকল্প থেকে সহায়তা করা হচ্ছে।