এমবিবিএস ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেছেন পাবনার মেয়ে মিশরী মুনমুন। তিনি পাবনা মেডিক্যাল কলেজ কেন্দ্র থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তার মোট প্রাপ্ত নম্বর ২৮৭.২৫।
দরিদ্র পরিবারে খুব সাধারণভাবে বেড়ে উঠা পাবনার রাধানগর নারায়নপুরের মেয়ে মিশোরী মুনুমন পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
মুনমুনের বাবা মো. আব্দুল কাইয়ুম পাবনা শহরতলীর রাধানগর নারায়ণপুর মহল্লার বাসিন্দা। তিনি স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সাধারণ ওয়ার্কার।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল বাবার স্বল্প আয়ে আর্থিক দৈন্যতায় কষ্ট হলেও ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিল সে। সব সময় ভাল ফল করলেও এই সাধারণ মেয়েটিও যে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় সারাদেশে প্রথম হবে তা ধারণা করেনি কেউ।
সবাইকে তাক লাগিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় প্রকাশিত এমবিবিএস ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা মুনমুন হয়েছে দেশ সেরা। গ্রামে বইছে উৎসবের আমেজ। বন্ধুবান্ধবী সহপাঠিদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হচ্ছেন মুনমুন। বাড়িতে ছুটে আসছেন গর্বিত শিক্ষকরাও।
মুনমুনের পরিবার জানায়, শহরের ইছামতি সরকারি প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি হন। জেএসসি, এসএসসিতে জিপিএ-৫ এর পর পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ নিয়ে পাস করেন তিনি।
করোনা পরিস্থিতিতে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গত কয়েকমাস নিজ বাড়িতেই রাতদিন কঠোর পরিশ্রম করে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন মুনমুন।
বাবা মা তিন বোনের পরিবারে মুনমুন সবার ছোট। মুনমুনের সাফল্যে খুশি পরিবারের সবাই। দেশ সেরা ফলাফলের পেছনের গল্পটা নিজ মুখে বলেন তিনি।
মিশরী বলেন, প্রতিদিন ফজরের নামাজ ও কোরআন তেলোয়াতের মধ্য দিয়ে পড়াশুনা শুরু করতাম, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতাম মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগের জন্য। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে অসহায় চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সুচিকিৎসার ব্যাবস্থা করব। আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। বাবা মায়ের অনুপ্রেরণা আমাকে সাফল্য অর্জনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের সঠিক ভালবাসা ও দিকনির্দেশনা আমাকে প্রতিনিয়ত সাহস যুগিয়েছে।
মফস্বল শহরে থেকেও এত ভাল ফলাফল কিভাবে অর্জন করলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে মিশোরী বলেন, মফস্বল হোক আর শহরে হোক লক্ষ্য স্থীর করে সঠিক পরিকল্পনায় পড়াশুনা করলে সাফল্য লাভ সম্ভব। আমার অনেক বান্ধবী ভর্তি হতে পারেনি তারা সময়কে সঠিকভাবে কাজে না লাগানোর জন্য।
মুনমুনের বাবা মো. আব্দুল কাইয়ুম বলেন, হাজারো কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করেছি। এত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে সারাদেশে প্রথম হবে স্বপ্নেও ভাবি নাই।
মেয়ের মা গৃহকর্তা মুসলিমা বেগম বলেন, আজকের এইদিনের মত আনন্দ আমার জীবনে কোনদিন আসেনি। খুবই খুশি লাগছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। তিনি জানান, মিশোরী ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল। ।খুব বেশি সময় না পরলেও যতোটুকু পড়তো ততোটুকু মনোযোগ দিয়েই পড়তো । যার ফলে ক্লাসে বরাবরই ভালো রেজাল্ট ছিল তার। ক্লাস এইট, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়েছে।
মেয়েকে নিয়ে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সন্তান ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবায় নিবেদিত প্রাণ হবে, চিকিৎসা সেবায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। দেশ ও সমাজের জন্য কাজ করবে।
এক সময় মানুষ আমার মাঝে হতাশার বীজ বপন করে, মেয়ের পড়াশুনা নিয়ে হতাশায় চিন্তায় দিন কাটত, প্রতিবেশীর অনেকেই বলল মেয়েকে কেন এত পড়াতে হবে, দ্রুত বিয়ে দিয়ে দাও। মেয়ের জন্য কটু কথাও শুনতে হয়েছে। আমার মেয়ে মেডিক্যালে দেশসেরা হয়েছে এটা গর্বের।
প্রতিবেশী পাবনা জেলা স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম মোস্তফা জানান, মিশোরী ছোট থেকেই মেধাবী ছিল। আমি তার শিক্ষক হিসেবে গর্ববোধ করি। এ জয় পুরো পাবনাবাসীর। বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য অবিস্বরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অন্য ছাত্রীদের উদ্যোশে তিনি বলেন, সবাইকে বলব তোমরা মিশোরীকে অনুসরণ করো, তার থেকে শিক্ষা নাও, যে একজন মফস্বল শহরের মেয়ে হয়ে মেডিক্যালে সারা দেশে প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. হুমায়ুন কবির মজুমদার বলেন, আমরা খুবই গর্ববোধ করছি এই সাফল্যে । শিক্ষকরা সব সময় তার খোঁজ খবর নিয়েছে। মিশোরী আমাদের কলেজের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমরা তার সাফল্যে গর্বিত।
রবিবার( ৪ এপ্রিল) সন্ধায় স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর মেডিক্যালের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে।পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ৪৮ হাজার ৯৭৫ জন শিক্ষার্থী। পাসের হার ৩৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছেন মিশোরী মুনমুন। তার রোল নম্বর ২৫০০২৩৮। তিনি পাবনা মেডিক্যাল কলেজ কেন্দ্র থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ভর্তি পরীক্ষার ১০০ নম্বরের মধ্যে তিনি পেয়েছেন ৮৭.২৫ নম্বর।