জাতীয়, সংস্কৃতি

একজন মুর্তজা বশীর; নক্ষত্রের পতন

কামরুল ইসলাম

ডিবিসি নিউজ

শনিবার ১৫ই আগস্ট ২০২০ ১২:৪৭:১২ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

বর্ণময় এক জীবন ছিলো মুর্তজা বশীরের। ছিলেন একাধারে ভাষা সংগ্রামী, চিত্রশিল্পী, লেখক ও গবেষক। চিত্রকলায় অবদানের জন্য ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পদক পেয়েছেন মুর্তজা বশীর।

১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায় স্বনামধ্যান পরিবারে তার জন্ম। বাবা প্রখ্যাত ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর, মা মরগুবা খাতুন।

ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনে শিক্ষাজীবন শুরু করে পরে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস এ পড়েছেন, এখন যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। এরপর ১৯৫৬ সালে মুর্তজা বশীর উচ্চতর শিক্ষার জন্য বাবার অর্থে ইতালির ফ্লোরেন্সে যান। আকাদেমিয়া দ্য বেল্লি আর্টিতে এক বছর চিত্রকলা এবং আরেক বছর ফ্রেসকো নিয়ে পড়াশোনা করেন। ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর ঐতিহ্য তাকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করে। ফ্লোরেন্সে মুর্তজা বশীরের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল 'লা পার্মানেন্ট' গ্যালারিতে। ফ্লোরেন্সে অবস্থানকালীন আঁকা চৌদ্দটি তৈলচিত্র এতে ছিল। এছাড়াও তিনি ফ্রান্সেও অধ্যয়ন করেন।

বিদেশে পড়তে যাবার আগে ১৯৫৫ সালে ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ড্রইং শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। পরে ইতালিতে পড়াশোনার জন্য আর কন্টিনিউ করেননি। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-প্রতিবাদে মুর্তজা বশীর ছিলেন অগ্রভাগে। ১৯৫২ সালে ভাষা সৈনিক হিসেবে এঁকেছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনের জন্য অসামান্য ড্রয়িং, পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ম্যুরাল, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি উৎসর্গকৃত ‘এপিটাফ’ সিরিজ, সমাজের দমবন্ধ করা বৈষম্য ও ব্যক্তিগত জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের বিমূর্ত ক্যানভাসের ‘দেয়াল’ সিরিজ, অন্তর্গত বোধের আনন্দ আখ্যানমূলক রং মাখানো ‘পাখা’ সিরিজ, আধ্যাত্মিক অনুভাবনার ‘কলেমা’ সিরিজসহ মূর্ত-বিমূর্ত অসংখ্য শিল্পকর্মে আমাদের শিল্পজগতকে ঋণী করে গেছেন।

‘রক্তাক্ত ২১শে’, ‘দেয়াল’, ‘শহীদ শিরোনাম’, ‘কালেমা তাইয়্যেবা’, ‘পাখা’ শিল্পী মুর্তজা বশীরের আঁকা উল্লেখযোগ্য সিরিজ। তিনি ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’ নামে একটি শিল্পধারার প্রবর্তক। এছাড়াও ফিগারেটিভ কাজে পূর্ব পশ্চিমের মেলবন্ধনে তিনি স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন।

আঁকাআঁকি জগতের বাইরে মুর্তজার রয়েছে নিজস্ব লেখক ও গবেষক সত্তা। ১৯৭৮ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয় তার আলোচিত উপন্যাস ‘আলট্রামেরিন’। তবে শিল্পীর প্রথম ছোট গল্প ‘পার্কের একটি পরিবার’ প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায়। তাছাড়া মুর্তজা প্রকাশ করেছেন গল্প সংকলন ‘গল্পসমগ্র’ ও চারটি কাব্যগ্রন্থ। সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থের নাম ‘সাদায় এলিজি’।

তাঁর গল্প গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম ‘কাঁচের পাখির গান’। কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ত্রসরেণু’, ‘তোমাকেই শুধু’, ‘এসো ফিরে অনুসূয়া’, ‘সাদায় এলিজি’। উপন্যাস ‘আল্ট্রামেরিন’, ‘মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে’, ‘অমিত্রাক্ষর’। নির্বাচিত রচনার মধ্যে রয়েছে : ‘মূর্ত ও বিমূর্ত’, ‘আমার জীবন ও অন্যান্য’। গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’।

গবেষক হিসেবেও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কনিষ্ঠ পুত্র মুর্তজা নিজস্ব কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলার হাবশী সুলতানদের নিয়ে করেছেন মৌলিক গবেষণা। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন।

বহুমাত্রিক প্রতিভার স্মারক মুর্তজা বশীর সিনেমাতে ছিলেন সরব। উর্দু চলচ্চিত্র 'কারোয়াঁ' এবং 'ক্যায়সে কাহু', বাংলা চলচ্চিত্র 'নদী ও নারী'র চিত্র নাট্যকার ও শিল্প নির্দেশনা করেছেন।

আরও পড়ুন