আন্তর্জাতিক, ভারত, ইউরোপ

পশ্চিমা চাপেও রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বাড়াচ্ছে ভারত

ফারুক

ডিবিসি নিউজ

রবিবার ৮ই মে ২০২২ ০২:১৯:৫০ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখা নিয়ে পশ্চিমাদের একের পর এক হুঁশিয়ারির পরও রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি বাড়িয়ে তুলেছে ভারত।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে ভারতের মোট জ্বালানি তেল আমদানিতে রাশিয়ার অবদান ছিল ১ শতাংশেরও কম। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশে। গত বছর ভারতের রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির দৈনিক গড় ছিল ৩৩ হাজার ব্যারেল। যুদ্ধ শুরুর পর মার্চে রাশিয়া থেকে ভারতীয় পরিশোধনাগারগুলোর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দৈনিক গড় আমদানি দাঁড়ায় তিন লাখ ব্যারেলে। এপ্রিলে তা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়ায় সাত লাখ ব্যারেলে।

চলতি মাসের মাঝামাঝি রাশিয়ার বাল্টিক সাগর-তীরবর্তী বন্দর থেকে পণ্যবাহী সাতটি কার্গো ভারতের উদ্দেশে রওনা দেয়ার কথা রয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে দেশটি নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। এক্ষেত্রে ‘নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায়’ রাখার বিষয়টিকে ভারতের মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে দেখছেন না বিশ্লেষকরা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে ‘অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ’। সস্তায় রুশ জ্বালানি তেল আমদানির এ সুবর্ণ সুযোগ কোনোভাবেই ছাড়তে চাইছে না ভারত।

তাদের এ বক্তব্যের পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের বাণিজ্য পরিসংখ্যান। যুদ্ধ শুরুর আগে ভারতের মোট জ্বালানি তেল আমদানিতে রাশিয়ার অবদান ছিল ১ শতাংশেরও কম। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশে। গত বছর ভারতের রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির দৈনিক গড় ছিল ৩৩ হাজার ব্যারেল। গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে দেশটি থেকে ভারত কোনো জ্বালানি তেল আমদানি করেনি। যুদ্ধ শুরুর পর আকস্মিকভাবেই আমদানি বাড়িয়ে তোলে ভারত। মার্চে রাশিয়া থেকে ভারতীয় পরিশোধনাগারগুলোর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দৈনিক গড় আমদানি দাঁড়ায় তিন লাখ ব্যারেলে। এপ্রিলে তা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়ায় সাত লাখ ব্যারেলে।

রাশিয়ার শীর্ষ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান রোসনেফট। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে সাত লাখ টন জ্বালানি তেল (ইউরাল ব্লেন্ড) ক্রয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ভারতের রিফাইনারি (জ্বালানি তেল পরিশোধনকারী) প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন। চলতি মাসের মাঝামাঝি রাশিয়ার বাল্টিক সাগর-তীরবর্তী বন্দর থেকে এ পণ্যবাহী সাতটি কার্গো ভারতের উদ্দেশে রওনা দেয়ার কথা রয়েছে।

জ্বালানি তেলের মূল্যের বিষয়ে বরাবরই সংবেদনশীলতা দেখিয়ে এসেছে ভারত। পণ্যটির মূল্য ‘কৃত্রিমভাবে’ বাড়িয়ে তোলার অভিযোগ তুলে দেশটি এতদিন ওপেক ও ওপেক প্লাস জোটের সমালোচনা করে এসেছে। যুদ্ধ শুরুর আগে দেশটির পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যপ্রাচ্য থেকে পণ্যটি আমদানিতে আগ্রহ ছিল বেশি। মানে ভালো হলেও পরিবহন খরচের কারণে রাশিয়া থেকে খুব বেশি জ্বালানি তেল কেনেনি প্রতিষ্ঠানগুলো।

বৈশ্বিক জ্বালানি তেল আমদানিকারক দেশের তালিকায় ভারতের অবস্থান তৃতীয়। বর্তমানে দেশটির রিফাইনারিগুলো রুশ রফতানিকারকদের সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্য নিয়ে দরকষাকষি করে চলেছে। ভারতীয় আমদানিকারকরা চাইছেন প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের মূল্য ৭০ ডলারের কমে নামিয়ে আনতে। পরিবহন, অর্থায়ন ও বিধিনিষেধজনিত নানা সংকট মোকাবেলার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা অল্প মূল্যে পণ্যটি কিনতে চাইছেন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, সস্তায় রাশিয়ার উত্কৃষ্ট মানের জ্বালানি তেল কিনে নেয়ার এ সুযোগ কোনোমতেই ছাড়তে চাইছে না ভারতীয় রিফাইনারিগুলো। যদিও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল ক্রয়ের বিষয়টি নয়াদিল্লির স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এতদিন রুশ জ্বালানি তেলের সর্বোত্কৃষ্ট বাজার আদর্শ ইউরাল ব্লেন্ডের গন্তব্য ছিল ইউরোপ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউসহ পশ্চিমা দেশগুলো একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকে রাশিয়ার ওপর। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রুশ জ্বালানি তেল আমদানির ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবছে। আরোপিত হলে এ নিষেধাজ্ঞা কয়েক বছর চালু থাকারও সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় রাশিয়াও নতুন বাজার খোঁজার পাশাপাশি মূল্যছাড় দিয়ে হলেও জ্বালানি পণ্যের রফতানি অব্যাহত রাখতে চাইছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে এ সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে ভারতীয় রিফাইনারিগুলো। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বড় ধরনের ছাড়ে স্বল্পমূল্যে জ্বালানি তেল আমদানি করছে। এসব পরিশোধনাগারে আমদানীকৃত জ্বালানি তেল পরিশোধনের মাধ্যমে ডিজেল ও জেট ফুয়েল উৎপাদন হয়। নিজস্ব চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি পরিশোধিত এসব জ্বালানি পণ্য ভালো মার্জিনে রফতানিও করে থাকে রিফাইনারিগুলো।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের জন্য কভিডের অভিঘাত কাটিয়ে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সঙ্গে ভারত ও রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আরো জোরালো হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রুশ অর্থনীতিকে চেপে ধরার প্রয়াসকে আরো কঠিন করে তুলতে পারে। এমনকি ইন্দো-মার্কিন যৌথ প্রয়াসে চীনকে মোকাবেলার বিষয়টিও আরো জটিল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ মুহূর্তে সস্তায় জ্বালানি তেল আমদানির সুযোগকে কাজে লাগানোর বিষয়টিতেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত। দেশটির অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ গত মাসেও বলেছেন, যদি জ্বালানি তেল সুলভ হয় এবং ছাড়ে পাওয়া যায়, তাহলে তা কিনব না কেন? এটি তো আমাদের জনগণেরই প্রয়োজন।

ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর পর পরই রাশিয়ার জ্বালানি তেল বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি পুরোপুরি বদলে যায়। ওই সময় থেকেই দেশটির জ্বালানি বাণিজ্যে আঘাত হানার পশ্চিমা প্রয়াস জোরালো হয়ে উঠতে থাকে। জবাবে কৃষ্ণ সাগর হয়ে উত্তর ইউরোপমুখী জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকারগুলোকে ভারতের দিকে পাঠানো শুরু করে রাশিয়া। সামনের দিনগুলোয় দুই দেশের জ্বালানি বাণিজ্যের ব্যাপ্তিকে আরো স্ফীত করে তুলতে পারে ইইউর প্রস্তাবিত নিষেধাজ্ঞা। রাশিয়া, পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার পর থেকেই ইইউর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, ইইউর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে তা শেষ পর্যন্ত নতুন এক জ্বালানি যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।

রাশিয়া থেকে ভারতে আসা জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকারগুলোর বড় একটি অংশ পণ্যটি খালাস করবে গুজরাটের জামনগরে। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রিফাইনারি কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। কিছু ট্যাংকার জ্বালানি তেল খালাস করবে গুজরাটেরই ভাদিনগরে। সেখানে রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি কোম্পানি রোসনেফটের ভারতীয় অংশীদার নায়ারা এনার্জির মালিকানাধীন একটি পরিশোধনাগার রয়েছে।

আরও পড়ুন