জেলার সংবাদ, অপরাধ, কৃষি

যশোর থেকে ভেজাল সার ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে

সাকিরুল কবীর রিটন, যশোর প্রতিনিধি

ডিবিসি নিউজ

সোমবার ২১শে সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৬:৩৯:৩০ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

যশোরে তৈরী ভেজাল সারের হুমকিতে পড়ছে কৃষিজমি ও শস্যভান্ডার। কমছে মাটির উর্বরতা, বাড়ছে কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি। পঁচা শেওলা, পাথরের কুচি, ডিনামাইট পাউডার, পোড়ামাটি, শামুক ও পাথর কুচির সঙ্গে রং মিশিয়ে বাধাহীনভাবেই তৈরি করা হচ্ছে এসব ভেজাল সার।

মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে ফেলার মতো উপাদান মিশিয়ে কারখানাগুলোতে উৎপাদিত হচ্ছে ভেজাল দস্তা, জিংক, টিএসপি ও এমওপি সার। পরে এগুলো যশোর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।

কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি, নিয়মিত তদারকি করেও ভেজাল সার উৎপাদন বন্ধ করতে পারছেন না তারা। নকল সার তৈরির অভিযোগে বেশ কয়েকটি কারখানা সিলগালা করা হয়েছে কয়েকবার। দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তবুও কৃষি বিভাগের ব্যস্ততার সুযোগে গোপনে নকল সার তৈরি করে যাচ্ছে ওরা। তবে এর বিরুদ্ধে খুব শিগগির অভিযান চালানো হবে।

জানতে চাইলে যশোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, যশোরে আমি যোগ দিয়েছি নতুন। ভেজাল সারের অভিযোগ পাচ্ছি; তবে কোনো প্রমাণ নেই আমার কাছে। এ ব্যাপারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে বলেছি। প্রশাসনের সঙ্গেও বসব। নকল সার তৈরি বন্ধে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। যারা ভেজাল সারের ব্যবসা করে কৃষিকে ক্ষতি করছে তাদের কোনোভাবেই রেহাই দেয়া হবে না।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকতা শেখ মো. নুরুল্লাহ বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে অনেক কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও চলছে। তবুও তারা লুকিয়ে নকল সার তৈরি করে যাচ্ছে। আমাদের ভেজালবিরোধী অভিযান খুব তাড়াতাড়ি শুরু হবে এবং এটা চলমান থাকবে।

সদর উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের সূত্র অনুযায়ী, উপজেলাটিতে ছোট-বড় ২১টি দস্তা সার উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধন আছে সুফলা এগ্রো কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ ও এ আর এগ্রো কেমিক্যালাসহ মাত্র তিনটির। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে ১৩টি কারখানা সিলগালা এবং ভেজাল সার ও সরঞ্জামাদি ধ্বংস করা হলেও ২০১২ সালের শেষের দিক থেকে ভেজাল সারের উৎপাদন বেড়ে যায়। ভেজাল বিরোধী অভিযান চালিয়ে গত পাঁচ বছরে ওই সব কারখানার কয়েকটি সিলগালা করা হয়। কোনো কোনোটির নিবন্ধন নবায়নের অনুমতি দেয়া না হলেও থেমে থাকেনি ভেজাল সার উৎপাদনের কার্যক্রম। অভিযোগ জেলা কৃষি অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকতা আর প্রশাসনকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে হাত করে ভেজাল সারের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে একাধিক অসাধু চক্র। এ চক্রের সদস্যরা দেশি-বিদেশি নামিদামি কোম্পানির নকল প্যাকেটে ভেজাল সার ভরে বড় বড় দোকানে বিক্রি করে। অন্যদিকে, এদের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দ করলে অনৈতিক সুবিধাবাদী একপক্ষ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার নেমে যায়।

জানতে চাইলে যশোরের পুলিশ সুপার (এসপি) মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, যশোরে ভেজাল সারের কারবার সম্পর্কে আমার জানা নেই। কেউ সশরীরে এসে অভিযোগ করেননি। তাছাড়া বিষয়টি ডিসি, ইউএনওদের জানার কথা, নিশ্চয়ই তারাও জানেন না। তারা জানলে আমাকে বলতেন। যদি এ বিষয়ে প্রমাণ পাই অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার সদর উপজেলাতেই রয়েছে ছোট বড় ২১টি খারাখানা। যার অধিকাংশই নামবিহীন। এদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে মামলা। উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে ভেজাল কারখানার যে নাম গুলো পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে বড় বালিয়াডাঙ্গা বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে মো. রেজাউল ইসলামের মেসার্স সোনালী এগ্রো কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ, আড়পাড়া পূর্ব মাঠপাড়া এলাকার মাহাবুবুর রহমানের কিষাণ ফার্টিলাইজার, শাহপুরের হোসেন আলীর নামবিহীন কারখানা, শেখহাটির এএফ এগ্রো কেমিক্যাল ইন্ডাট্রিজ, ঘুরুলিয়া সাদ্দাম রোডের আনোয়ার হোসেন লাল্টুর সুমি এগ্রো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, আরবপুরের পতেঙ্গালীর মহসিন কবীরের মেসার্স এস এম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, ঢাকা রোড তালতলার কামাল হোসেনের জেস এগ্রো লিমিটেড, শংকরপুরের জাহাঙ্গীর হোসেনের মেসার্স কেয়া এগ্রো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, হাশিমপুর সদরের হারুন অর রশিদের এ এম এগ্রো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, নতুন উপশহরের ৮নং সেক্টরেও আবুলের রয়েছে কসমিক এগ্রো কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ, কিসমত রাজাপুরের রবিউল ইসলামের আর এম এফ ফার্টিলাইজার ইন্ডাষ্ট্রিজ, উপশহরের সাউদার্ন এগ্রো কেমিক্যালসহ অন্যান্য।

এদের প্রায় সকলের বিরুদ্ধে নকল সার তৈরির অভিযোগে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের করা মামলা রয়েছে। মামলা মাথায় নিয়েই সুযোগ বুঝে এরা নকল সার তৈরি করে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাচ্ছে। পাথরের কুচি, ডিনামাইট পাউডার, পোড়া মাটি, শামুকের কুচিসহ জমির জন্য ক্ষতিকর এসব পদার্থের সঙ্গে রং দিয়ে তৈরি করছে ভেজাল সার। কারখানার মালিকরা স্থানীয় লোকজনের চোখ এড়াতে রাতের আঁধারে ও দিনের সুবিধাজনক সময়ে নানা কৌশলে নিজ বাড়িতে খেজুরবাগান, পেঁপেবাগানের ভেতরে এবং কারখানা তালা দিয়ে কেউ কেউ ভিতরেই এসব কারবার করে যাচ্ছে। পরে ওই সার শিল্পনগর নওয়াপাড়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সারের বড় মোকামে বাজারজাত করে। ভারত, চীন ও কোরিয়া থেকে আমদানি করা উন্নতমানের সার বলে সর্বোচ্চ মূল্যে কৃষকদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয় এসব নকল সার। অনেক টাকা খরচ করে প্রস্তুত করা জমিতে এসব নকল সার ব্যবহার করে কৃষকরা ফসল ঘরে তুলতে না পেরে আর্থিক সংকটের মুখে পড়ছে। টাকা দিয়ে কিনে সেই সারের বস্তা ফেলে দিচ্ছেন অনেকেই।

যশোর সদর উপজেলার রহমতপুর গ্রামের শুকুর আলী নামের এক কৃষক এ প্রসঙ্গে বলেন, এসব ভেজাল সার চোখে দেখে বোঝা যায় না। জমিতে দেয়ার পর ১ সপ্তাহের মধ্যে ফসল দ্রুত বাড়ে। এরপর জমিতে ছোট ছোট শামুক ও পিঁপড়া হয়। জমির মাটি কালো হয়ে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। কয়েকদিন পর ফসলের গোড়া পঁচে গাছ মরে যায়। এছাড়াও এই সার ব্যবহার করে অনেকর হাতে ও শরীরে ঘা হচ্ছে।

সরেজমিনে গিয়ে যা দেখা গেলো: উপজেলার বাহাদুরপুর-আড়পাড়া সড়কের শাহাপুর গ্রামে ঢুকতেই হোসেন আলীর নামবিহীন কারখানা। এর মূল ফটকে তালা ঝুলছে। স্থানীয়রা জানান, গভীর রাতে মাঝে মাঝে কারখানার লাইট জ্বলে। তখন টিনের চালের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়।

এলাকাবাসী জানান, এসব কারখানায় ভেজাল সার তৈরির অভিযোগ রয়েছে। এখানকার ভেজাল দস্তা, জিংকসহ অন্যান্য সার সারাদেশেই পাঠানো হয়। তবে রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে বেশি যায়।

ঘুরুলিয়া সাদ্দাম রোডের আনোয়ার হোসেন লাল্টুর সুমি এগ্রো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানা। কারখানার ভেতরে দুজন কর্মী পরিষ্কার পরিছন্ন করছিলেন। কারখানার আর লোকজন কই ও ভেতরের গোডাউনে বস্তার ভেতরে কি জানতে চাইলে কাশেম নামের কারখানার কর্মচারী বলেন, ওগুলো সার বানানোর অনেক রকম জিনিস। কি ধরনের জিনিস জানতে চাইলে কিছু বলতে রাজি হয়নি কারখানার ওই কর্মচারী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সার উৎপাদনকারী এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই আমরা এ ব্যবসা করে থাকি।

জানা গেছে, গত ৮ বছরে ওইসব কারখানার অন্তত ১৫টি সিলগালা করা এবং দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া নিবন্ধন নবায়নের অনুমতি দেয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে পাঁচটি কারখানা সিলগালার পর মালিকদের আসামি করে পাঁচটি মামলা, ২০১০ সালে ১১টি কারখানায় অভিযান চালিয়ে মালিকদের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা ও দুটি কারখানা থেকে জরিমানা আদায় করা হয়। ২০১১ সালে ১১ দফা অভিযান চালিয়ে পাঁচটি মামলা, চার হাজার কেজি ভেজাল সার ধ্বংস ও দুটি কারখানাকে জরিমানা করা হয়। ২০১২ সালে দুটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে দুটি মামলা করা হয়। পরে গত বছর থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো অভিযানই চালানো হয়নি।

আরও পড়ুন