মতামত, পরামর্শ, কিডজ জোন

শিশুদের জন্য টেলিভিশন হউক নিরাপদ

আকরাম হোসেন

ডিবিসি নিউজ

মঙ্গলবার ৪ঠা মে ২০২১ ০৯:২৭:৪১ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে টেলিভিশন হউক নিরাপদ।

গত একবছরের উপরে স্কুল বন্ধ, তাঁর মধ্যে আবার অধিকাংশ সময় লকডাউন থাকাতে শিশু-কিশোরেরা বাসাতেই অবস্থান করছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে ঘরের মধ্যে আমাদের সন্তানেরা অনেকটা বন্দি থাকাতে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।

তারা কোন খেলাধুলা করতে পারছে না, না পারছে কোন বন্ধু বা আত্মীয়দের সাথে মিশতে, না পারছে ওদের প্রান জুড়ানো হাসি নিয়ে কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে। ওদের মেধার বিকাশের জন্য, ওদের সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি প্রয়োজন বন্ধুদের সাথে মিশা, খেলাধুলা করা, ওদের মনের কথাগুলো সাবলীল ভাবে অন্যের কাছে প্রকাশ করা কিন্তু ওরা এইসবের কিছুই করতে পারছে না। তাই মা-বাবা হিসাবে আমাদের উচিত হবে, ওদের ব্যাপারে আরেকটু বেশী যত্নবান হওয়া, মনোযোগের সাথে ওদেরকে সময় দেয়া, ওদের সাথে বন্ধুর মত আচরণ করা।

প্রায় প্রতিটি ঘরে, বাচ্চারা আজ দিনের অধিকাংশ সময় টিভি, গেম বা ইউটিউবে অতিবাহিত করছে কিন্তু দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের সামনে থাকাতে ওরা এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে, সাথে সাথে ওদের শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। স্ক্রিনের উপর ওদের নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য আমরা ওদের বই পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারি, শত ব্যাস্ততার মাঝেও নিয়মিত ওদের জন্য কিছু সময় রাখা, ওদের সাথে গল্প করা, ছবি আঁকা ও গান শেখায় উৎসাহ দেয়া, খেলাধুলায় অংশ নেয়া থেকে শুরু করে ওদের মনকে ভালো রাখার জন্য আমাদের প্রয়োজন একটু সচেতনতা ও একটু পরিকল্পনা ।    

শিশু সন্তানদের নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেলে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ত কম বেশী সবাই হয়েছেন যে হঠাৎ কোন বেলুন ব্যাবসায়ী বা হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা আপনাকে জিজ্ঞেস না করেই আপনার সন্তানের হাতে ওগুলো ধরিয়ে দিয়েছেন। আপনি হয়ত চান না যে আপনার সন্তান হাওয়াই মিঠাই খাক কিন্তু আপনার সন্তানের হাতে হাওয়াই মিঠাই থাকাতে সে খুব আনন্দিত এবং ইতিমধ্যে সে তা খাওয়াও শুরু করে দিয়েছে। আপনার আর কিছুই করার থাকে না সেই মুহূর্তে শুধু তাঁর দাম পরিশোধ করা ছাড়া।

যারা শিশুদের খাবার বা ওদের উপযোগী কোন পণ্যের ব্যবসা করে, আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, তারা সর্বপ্রথম শিশুদের মনে সেই পণ্যের জন্য একটা আকর্ষণ তৈরি করে। এই আকর্ষণ ধীরে ধীরে শিশুদেরকে একটা আসক্তির দিকে নিয়ে যায়। ওদের সাথে টিভি দেখার সময় একটা শিশু অনুষ্ঠান দেখে আমি একেবারেই মুগ্ধ কারণ প্রোগ্রামটা খুব যত্ন নিয়ে করা যেন ওদের মেধা, মননশীলতা ও সৃজনশীলতা বিকশিত হয়।

কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, এই শিশু অনুষ্ঠান সহ সব চ্যানেলের প্রতিটা অনুষ্ঠানের বিরতিতে যে বিজ্ঞাপনগুলো দেয়া হয়, আমার মতে তা শিশুদের জন্য রীতিমত ভয়াবহ। প্রতিটা বিজ্ঞাপন এমনভাবে দেয় যেটা দেখে প্রতিটি শিশুর মনে হবে যে, এই পণ্যটা ছাড়া তাঁর জীবন একেবারে বৃথা। কোমল পানীয়গুলোর উপকারের চেয়ে ৯০ শতাংশেরও বেশী শারীরিক ক্ষতির দিক থাকলেও এমন ভাবে এটা উপস্থাপন করা হয় যে, এই ধরনের পানীয় ছাড়া খাবার অসামাপ্ত থেকে যায়।

একটা বিজ্ঞাপনে শিশুদের উৎসাহিত করা হয় এভাবে যে, সারাদিন মিঠাই-মণ্ডা যা খুশি খাও কোন অসুবিধা নাই, শুধু তাদের টুথপেস্টে দিয়ে দাঁত মাজলেই সেটা সারাক্ষণ তাদের দাঁত কে সুরক্ষা দিবে। বরং তাদের বিজ্ঞাপনে মেসেজটা এভাবেও দেয়া যেত যে, দাঁত ভালো রাখার জন্য চকলেট, আইসক্রিম জাতিয় খাবার পরিহার করুণ এবং এই টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজুন।

এনার্জি ড্রিঙ্ক এর নামে যে বিজ্ঞাপনগুলো দেয়া হয় তা একেবারেই উদ্ভট ও বাস্তবতা বিবর্জিত যা মানুষ কে শুধু বিভ্রান্ত করবে। এই এনার্জি ড্রিংকেরও আছে অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিন্তু প্রত্যেক শিশু মনে করবে, যে এই ড্রিঙ্কস খেলে সত্যিই বুঝি দানবের মত শক্তি পাওয়া যাবে। সারাদিন জুড়ে বিজ্ঞাপনে বিভিন্ন ধরেনের ক্ষতিকারক অখাদ্যগুলোকে কোমলমতি শিশুদের সামনে অত্যন্ত লোভনীয় ও আকর্ষণীয়ভাবে ক্রমাগতভাবে প্রচার করা হয় যা দেখে শিশুরা এই ক্ষতিকারক অখাদ্যগুলোকেই প্রকৃত খাবার বলে মনে করে আর এগুলো পাওয়ার জন্য তাদের মন সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে।

এই নগর জীবনে বেশিরভাগ পিতামতাই থাকেন কর্মব্যস্ত, তারা কিছু সময়ের জন্য বাচ্চদের একটু হয়ত টিভি স্ক্রিনের সামনে রেখে তাদের জরুরী কাজগুলো সেরে নিতে চান কিন্তু ওই সময়ে শিশুদের মন হয়ত ক্ষতিকারক খাবারের আকর্ষণে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এই কারনে পুষ্টিকর খাবারের প্রতি শিশুদের অনাগ্রহ তৈরি হয় কারণ ওদের মন পড়ে থাকে রঙিন কাগজে মোড়ানো পেকেট জাতীয় খাবারের দিকে।

ফ্রুটস জুসের নামে রং মিশ্রিত পানি, ক্ষতিকারক কেমিক্যাল দিয়ে বানানো লিচি, টেস্টিং সল্ট দিয়ে বানানো চিপস ও আইসক্রিম এর বিজ্ঞাপন দিতে দিতে এই অবস্থা হয়েছে যে এমনকি পিতামাতারাও এই সমস্ত ক্ষতিকারক খাদ্যকে শিশুদের স্বাভাবিক খাবার বলে মনে করা শুরু করেছেন। এই সমস্ত ক্ষতিকারক অনেক খাবারের সাথে আবার বিভিন্ন ধরনের খেলনা ফ্রি দেয়ার কথা বলে বাচ্চাগুলোকে করে তোলা হয় আরো বেপরোয়া, তখন বাচ্চাদের নিয়ন্ত্রণে রাখাও পিতামাতাদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে পড়ে।

আমাদের উচিত হবে শুধু একটা নির্দিষ্ট সময়ে ওদেরকে টিভি দেখতে দেয়া, ওদের কে নিয়ে একসাথে  টিভি দেখা, অনুষ্ঠান নির্বাচনে পরামর্শ দেয়া এবং যতটুকু সম্ভব বিজ্ঞাপনের পণ্যগুলোর ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে সচেতন করা । শিশুদের উপযোগী অনুষ্ঠানের নির্মাণের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনগুলোকেও ওদের উপযোগী করে তৈরা করা নিশ্চিত করতে পারলেই টেলিভিশনের পর্দা আমাদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ হবে। 

আবুল হাসনাত রোবেল, সহযোগী অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

আরও পড়ুন