হত্যাকারী ভাবলেশহীন দেখে প্রাথমিক ভাবে পুলিশ অনুমান করেছিল, জলি মনোরোগী। তবে তদন্ত যত এগোচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে পুলিশের অনুমান, নিছক মনোরোগই নয়, ১৪ বছর ধরে লাগাতার খুনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। থমাস পরিবারের সম্পত্তি দখল করতেই একের পর এক খুন করেছে জলি পোন্নামাট্টম।
পরিবারের সকলের সঙ্গে ডিনারে বসে মটন স্যুপ খাচ্ছিলেন আন্নামা থমাস। স্যুপ শেষ হওয়ার আগেই দম আটকে মারা গেলেন তিনি। দু’বছরের মেয়ে আলফাইনের মৃত্যুটা আরও মর্মান্তিক। খাবার টেবিলেই পানির গ্লাসে চুমুক দিয়েই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায় শিশুটি। ১৪ বছরে পরিবারের ৬ সদস্যকে খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত জলি পোন্নামাট্টমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে এ কথা জানিয়েছে কেরালা পুলিশ। আনন্দ বাজার পত্রিকা জানায়।
এতগুলি খুন, কিন্তু হত্যাকারী ভাবলেশহীন দেখে প্রাথমিক ভাবে পুলিশ অনুমান করেছিল, জলি মনোরোগী। তবে তদন্ত যত এগোচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে পুলিশের অনুমান, নিছক মনোরোগই নয়, ১৪ বছর ধরে লাগাতার খুনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। থমাস পরিবারের সম্পত্তি দখল করতেই একের পর এক খুন করেছে জলি পোন্নামাট্টম।
কেরালা পুলিশের তদন্তকারী অফিসার কে জি সিমন জানান, 'জলিকে শুধুই মনোরোগী বললেই হবে না। প্রাক্তন শ্বশুর শ্বাশুড়ি টম টমাস ও আন্নাম্মা টমাস খুনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। পরিবারের সর্বময় কর্তা ও কর্ত্রীকে সরিয়ে দিলে চালকের আসনে বসা যাবে এমনটাই ভেবেছিল জলি। তার মূল লোভ ছিল থমাস পরিবারের সম্পত্তিতে।’
শুধু কেরালা পুলিশই নয়, এই একই কথা বলেছেন জলির দেবর রোজো। তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন, আন্নাম্মা ও টমের বাড়ির দলিলও নকল করেছিল জলি। অর্থাৎ প্রথম থেকেই টমাস পরিবারের সম্পত্তির মালিকানা পাওয়াই ছিল জলির মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্যপূরণে যাদের বাধা মনে হয়েছে, তাদেরই একে একে সরিয়েছে জলি।
টার্গেটকে পৃথিবীকে সরাতে জলির অস্ত্র ছিল সায়ানাইড। পুলিশ জানায়, জলি প্রথম খুন করেছিল ২০০২ সালে। খাবার টেবিলে বসে মটন স্যুপ খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু হয় আন্নামা থমাসের। ওই স্যুপেই সায়ানাইড মিশিয়েছিল জলি। এর ছয় বছর পরে আন্নাম্মার স্বামী টম মারা যান। জেরায় জলি জানিয়েছে, টমকেও খাবারে সায়ানাই়়ড মিশিয়ে খুন করেছিল সে। ২০১১ সালে জলির প্রাক্তন স্বামী রয়কে বাথরুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে তার পাকস্থলীতে সায়ানাইড পেয়েছিল পুলিশ। কিন্তু কোনও অতিরিক্ত তথ্য না পেয়ে তদন্ত মাঝপথেই বন্ধ করতে বাধ্য হয় পুলিশ। সিদ্ধান্তে আসেন, আর্থিক সমস্যার জেরে আত্মহত্যা করেছেন রয়। এই ধারাবাহিক মৃত্যুতে সন্দেহ হয়েছিল আন্নাম্মার ভাই ম্যাথু মানজাদিলির। তিনি তদন্তের জন্য পুলিশকে চাপও দেন। বিপদ এড়াতে তাকেও একই ভাবে সরায় জলি। পুলিশের দাবি,ম্যাথুর কফিতে একই কায়দায় বিষ মেশানো হয়েছিল।
সম্পত্তির দখল পেতে কোনও মতেই পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। কারণ লক্ষ্য একটাই, বাড়ির দখল নেওয়া। তাই এই খুনগুলি চলাকালে জলি ভেবেচিন্তেই সম্পর্কে জড়িয়েছিল রয়ের চাচাতো ভাই সাজুর সঙ্গে। পঞ্চম খুনের শিকার, একবছরের শিশু আলফাইন শাজু, তার বর্তমান স্বামীর আগের পক্ষের মেয়ে। পুলিশ জানিয়েছে, তাদের বলা হয়েছিল, খাবার খাওয়ার সময় বিষম খেয়ে মৃত্যু হয়েছিল শিশুটির। ষষ্ঠ খুনের শিকার ফিলি, তিনি ছিলেন জলির বর্তমান স্বামীর প্রথমপক্ষের স্ত্রী ও আলফাইন শাজুর মা।
পুলিশের দাবি, জলির শেষ লক্ষ্য ছিল ননদ ও প্রাক্তন স্বামীর পরিবারের অন্য দুই দুই শিশু। জলি ভেবেছিল এরা সরে গেলেই আর কোনও বাধা থাকবে না থমাস পরিবারের সম্পত্তি দখলে। তবে ননদকে খুনের চেষ্টা ব্যর্থ হতেই সতর্ক হয়ে যায় সে।
গেল বুধবার রয় থমাসের এক চাচি এলসাম্মা সংবাদমাধ্যমে জানান ২০০২ সালে তার ছেলে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। রয়ের আরেক চাচাত ভাইও গলায় দড়ি দেন। তিনি দাবি করেন, আরও দুটি খুনের পিছনেও জলির হাত রয়েছে।
তবে পুলিশের ধারণা, এতগুলো হত্যাকাণ্ড জলি একা ঘটায়নি। তাকে প্রথম থেকে সাহায্য করত তার এক আত্মীয় এমএস ম্যাথু। ম্যাথুই ছিল সায়ানাইডের জোগানদার। সায়ানাইড আসত প্রজিকুমার নামক এক স্বর্ণকারের কাছ থেকে। পুলিশ তাদের দু’জনকেও গ্রেপ্তার করেছে।
এই সিরিয়াল কিলিংয়ের রহস্য ভেদ করতে ইতিমধ্যেই বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করেছে কেরালা পুলিশ। ইতিমধ্যে খুনের দায় স্বীকারও করেছে জলি।
প্রসঙ্গত, ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এ হত্যকান্ড গুলি সংগঠিত হয়। এরপর শাজুর সঙ্গে দ্বিতীয় বার বিয়ে হয় জলির। শ্বশুরের শেষ উইল অনুযায়ী সমস্ত সম্পত্তির উপর নিজের মালিকানা দাবি করেন জলি। কিন্তু এই নিয়ে প্রবাসে বসবাসকারী দেবর রোজো টমাসের সঙ্গে ঝামেলা চরমে পৌঁছয়। এমন পরিস্থিতিতে রোজো পরিবারের ঘটে যাওয়া পর পর রহস্যমৃত্যুর নতুন করে তদন্ত করার অনুরোধ নিয়ে পুলিশের অপরাধ দমন শাখায় আবেদন করেন। এরপরই সমস্ত ঘটনা সামনে আসে।
আবারও মৃতদেহের ফরেন্সিক পরীক্ষা হয়। তাতে দেখা যায়, মৃত্যুর আগে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু খেয়েছিলেন। প্রত্যেকের শরীরে সায়ানাইডের অস্তিত্ব মেলে।