বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষদের অধিকার আদায়ের প্রতিক হিসেবে ১লা মে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে কর্মঘণ্টা নির্ধারণসহ নানা ন্যায্য অধিকার আদায়ে শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের স্মরণে এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্য লাভ করে।
যুগে যুগে শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে আজকের আধুনিক শ্রমিক আন্দোলন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশেও যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে এ দিনটি। মহান মে দিবসে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে জাতীয় ছুটি থাকে। আরও অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবেও পালিত হয়ে আসছে। এবারের মহান মে দিবস ২০২৫ এর প্রতিপাদ্য-‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এ দেশ নতুন করে’।
কিভাবে সূচনা হলো মে দিবসের?
১৮৮৬ সালে ব্রিটিশ সমাজ সংস্কারক রবার্ট ওয়েনের এক চিন্তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলো দিনে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে এক বিরাট প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করে। রবার্ট ওয়েন ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি পূরণে স্লোগান ঠিক করেন, 'আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিনোদন এবং আট ঘণ্টা বিশ্রাম'। সবচেয়ে বড় আন্দোলনটা হয় সে বছরের পহেলা মে শিকাগোতে, যেখানে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক সমবেত হন। তখন কারখানায় কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা বা বিশ্রাম ছাড়াই টানা কাজ করে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। আর সেসময় শিকাগো ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পকারখানা ও ইউনিয়ন সংগঠনগুলোর কেন্দ্র।
পরবর্তী কয়েক দিনে এই আন্দোলনকে ব্যবসায়ী ও রাজনীতি মহল পছন্দ না করলেও আরও হাজার হাজার ক্ষুব্ধ শ্রমিক ও আন্দোলনকারী এতে যু্ক্ত হতে থাকেন। এ সময় কিছু নৈরাজ্যবাদীও এতে যোগ দেন যারা কোনো রকম নিয়ম ও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সামাজিক কাঠামো স্বীকার করেন না। উত্তেজনা আরও বাড়তে থাকে, পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদর মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। এতে একজন মারা যায় ও অনেকে আহত হয়।
পুলিশের নিষ্ঠুরতায় ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত বিক্ষোভকারী এবং শ্রমিক নেতারা পরদিন ৪ই মে শিকাগোর বিখ্যাত হেমার্কেট স্কয়ারে এক কর্মসূচির ডাক দেয়। এ সময় এক ব্যক্তি পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়েন।
ওই বিস্ফোরণের ফলে এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, সাতজন পুলিশ সদস্য নিহত হয় এবং ৬৭ জন কর্মকর্তা আহত হয়। চারজন বিক্ষোভকারীও নিহত হয় এবং ৩০ জনেরও বেশি আহত হয়। এই ঘটনা পরে পরিচিতি পায় ‘হে মার্কেট ম্যাসাকার’ হিসেবে। পরবর্তীতে আট জন নৈরাজ্যবাদী খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং তাদের দোষ ঠিকভাবে প্রমাণের আগেই তাদের অনেককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
এই ঘটনাগুলোর স্মরণে ১৮৮৯ সালে ২০টি দেশের সমাজকর্মী, শ্রমিক নেতা ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর এক আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে পহেলা মে তারিখ 'মে দিবস' পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
মে দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় শ্রমের প্রতি সম্মান এবং শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা একটি মানবিক দায়িত্ব। সময়ের পরিবর্তনে শ্রমিকদের চাহিদা এবং সংগ্রামের রূপ ভিন্ন হতে পারে, কিন্ত তাদের সম্মান ও নিরাপত্তা সবসময় হওয়া উচিত সমাজ তথা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। মহান মে দিবসের আদর্শকে ধারণ করে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সমতাপূর্ণ ও মানবিক সমাজ গড়ে তোলা এবং শ্রমের মূল্যায়নই হোক উন্নয়নের প্রকৃত ভিত্তি।
ডিবিসি/ মাওয়া