আজ ২১ শে ফেব্রয়ারি। দিনটি শহিদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই স্বীকৃতি অর্জন করাটা কিন্তু খুব সহজ ছিল না। অনেক পরিশ্রম এবং ত্যাগের ফসল এই অর্জন। এবার জেনে নেওয়া যাক কীভাবে দিনটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেল, এই স্বীকৃতি অর্জনে কার কার অবদান ছিল।
১৯৯৮ সালের ৯ই জানুয়ারি রফিকুল ইসলাম নামের এক কানাডা প্রবাসী বাঙালি জাতিসংঘের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা শহিদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে কফি আনানকে প্রস্তাব করেন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে যেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
সে সময় সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের নজরে এ চিঠিটি আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ শে জানুয়ারি রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারও কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন।
সেই অনুরোধ মোতাবেক রফিক তার সহযোদ্ধা আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে ‘এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজীভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারও কফি আনানকে ‘এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড’ -এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন, এবং চিঠির একটি কপি ইউএনও (UNO) -র ক্যানাডিয়ান অ্যাম্বাসেডর ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করেন।
এর মধ্যে একটি বছর পার হয়ে গেল। ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাসান ফেরদৌস সাহেব রফিক এবং সালামকে উপদেশ দেন ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের জোসেফ পডের সঙ্গে দেখা করতে। তারা জোসেফের সঙ্গে দেখা করার পর জোসেফ তাদের উপদেশ দেন ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করতে।
আনা মারিয়া রফিক-সালামের কথা মন দিয়ে শোনেন এবং তারপর পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫ টি সদস্য দেশ – কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে।
সে সময় বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী এম এ সাদেক এবং শিক্ষা সচিব কাজী রকিবুদ্দিন, অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমেদ, মশিউর রহমান (প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারিয়েটের তৎকালীন ডিরেক্টর), সৈয়দ মোজাম্মেল আলি (ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত), ইকতিয়ার চৌধুরী (কাউন্সিলর), তোজাম্মেল হক (ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনেরালের শীর্ষ উপদেষ্টা) সহ অন্য অনেকেই জড়িত হয়ে পড়েন। তারা দিন রাত পরিশ্রম করেন আরও ২৯ টি দেশকে প্রস্তাবটির স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ে।
অন্যান্য বাংলাদেশি এবং প্রবাসীদের কাছে ব্যাপারটা অগোচরেই ছিল- পর্দার অন্তরালে কি দুঃসাহসিক নাটক চলছিল সে সময়। এই উচ্চাভিলাসী প্রজেক্টের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা এবং কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরের জনা কয়েক লোক কেবল ব্যাপারটা জানেন, এবং বুকে আশা নিয়ে তারা সেসময় স্বপ্নের জাল বুনে চলেছেন প্রতিদিন।
১৯৯৯ সালের ৯ ই সেপ্টেম্বর ইউনেস্কোর প্রস্তাব উত্থাপনের শেষ দিন। তখনও প্রস্তাব এসে পৌঁছায়নি। ওদিকে রফিক সালামেরা ব্যাপারটি নিয়ে বিনিদ্র রজনী অতিক্রম করে চলেছেন। টেলিফোনের সামনে বসে আছেন, কখনও চোখ রাখছেন ইমেইলে।
আসলে প্রস্তাবটির পেছনে প্রধানমন্ত্রীর একটি সই বাকি ছিল। আর প্রধানমন্ত্রী তখন পার্লামেন্টে। পার্লামেন্টের সময়সূচির পরে সই করতে করতে প্রস্তাব উত্থাপনের সময়সীমা পার হয়ে যাবে। সেটা আর সময় মত ইউনেস্কো পৌঁছবে না। সব পরিশ্রম জলেই যাবে বোধ হয়।
প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে অনুরোধ করা হলো তিনি যেন প্রস্তাবটি সই করে ফ্যাক্স করে দেন ইউনেস্কোর দপ্তরে। অফিসের সময়সীমা শেষ হবার মাত্র একঘণ্টা আগে ফ্যাক্সবার্তা ইউনেস্কোর অফিসে এসে পৌঁছল।
১৬ই নভেম্বর কোন এক অজ্ঞাত কারণে বহুল প্রত্যাশিত প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর সভায় উত্থাপন করা হলো না। রফিক সালামেরা আরও একটি হতাশ দিন পার করলেন।
পর দিন – ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯। এক ঐতিহাসিক দিন। প্রস্তাব উত্থাপন করা হলো সভার প্রথমেই। ১৮৮ টি দেশ এতে সাথে সাথেই সমর্থন জানাল। সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হলো ইউনেস্কোর সভায়। এভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক দিবসে পরিণত হলো। এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে জাতিসংঘ।
সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, ব্লগ সহ বিভিন্ন পত্রিকা