চীনের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী বিমান সি-৯১৯ (C919) জেট লাইনার সম্প্রতি একটি নতুন মাইলফলক রেকর্ড অর্জন করেছে। মূলত চলতি ২০২৫ সালের ৪ঠা জুন, চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনস পরিচালিত ফ্লাইট (CZ3383) দক্ষিণ চীনের গুয়াংজু থেকে উড্ডয়ন করে সফলভাবে মধ্য চীনের হেনান প্রদেশের একটি ফিডার বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এটি ছিল কোনো ফিডার বিমানবন্দরে এই বিমানের প্রথম সফল ফ্লাইট পরিচালনা।
এর আগে, গত ২০২৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর, চীনের বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কমার্শিয়াল এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন অব চায়না (COMAC) তাদের তৈরি দশম ইআর সিরিজের বিমান চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনস এর কাছে হস্তান্তর করে। বিমানটি সাংহাই হংকিয়াও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিমানবহরে যুক্ত হয়।
তাছাড়া গত ২০২৩ সালের ২৮শে মে থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করার পর থেকে, সি-৯১৯ বিমান ইতোমধ্যে প্রায় ১৫ লক্ষ যাত্রী পরিবহণ করেছে বলে জানিয়েছে COMAC। এর ধারাবাহিকতায়, গত ২০২৪ সালের ২৯শে এপ্রিল চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্স C919ER সিরিজের ১০০টি বিমান কেনার জন্য ১০.৮ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা চীনের বিমান শিল্পে একটি নতুন যুগের সূচনা করে।
চীনের কমার্শিয়াল এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন অব চায়না (COMAC) মিডিয়াম রেঞ্জের সি-৯১৯ যাত্রীবাহী পরিবহণ বিমান নিয়ে কাজ শুরু করে আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে ২০০৭ সালে। প্রায় ১৬ বছর গবেষণা ও উন্নয়নের পর ২০২৩ সালে এটি প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে আকাশে ওড়ে। এই সাফল্য চীনের জন্য বেসামরিক বিমান শিল্পে এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তবে এখনো সি-৯১৯ যাত্রীবাহী বিমানের প্রায় ৬০% যন্ত্রাংশ, বিশেষ করে ইঞ্জিন, অ্যাভিওনিক্স ও ককপিট সিস্টেম, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে আমদানি করা হয়। চীন আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এই নির্ভরতা কমিয়ে ৬০-৭০% দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তার পাশাপাশি চলতি বছরেই চীন এই এয়ারক্রাফটের ম্যাস প্রোডাকশন লাইন চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই বিমানের প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এর দৈর্ঘ্য: ৩৮.৯ মিটার, উইংসস্প্যান: ৩৩.৬ মিটার এবং পে-লোড ক্যাপাসিটি: ১৫ টন। তাছাড়া এর অপারেশনাল রেঞ্জ: ৫,৫৭৬ কিলোমিটার এবং এটি আকাশের সর্বোচ্চ ৩৯,৮০০ ফিট উচ্চতায় উড্ডয়ন করতে পারে। শক্তি উৎপাদনের জন্য এটিতে দুটি শক্তিশালী ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের যৌথভাবে নির্মিত CFM International LEAP-1C টার্বোফ্যান ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে।
এর ম্যাক্সিমাম টেক অফ ওয়েট ৭৫,১০০ কেজি, ম্যাক্সিমাম ল্যান্ডিং ওয়েট ৬৭,৮০০ কেজি এবং ম্যাক্সিমাম ফুয়েল ক্যাপাসিটি ১৯,৫৬০ কেজি। এর সর্বোচ্চ গতি ০.৮২ ম্যাক এবং মোট আসন সংখ্যা হচ্ছে সর্বোচ্চ মোট ১৬৪টি (৮টি বিজনেস ক্লাস, ১৫৬টি ইকোনমি ক্লাস)। তাছাড়া চীন এর জেট লাইনারের পাশাপাশি ১২ হাজার কিলোমিটার লং রেঞ্জের সি-৯২৯ হেভি জেট লাইনার নিয়ে কাজ করছে।
চীন ইতোমধ্যেই তাদের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি সি-৯১৯ইআর সিরিজের সিভিল এয়ারক্রাফট ডিজাইন, তৈরি ও আধুনিকায়নে এখনও পর্যন্ত প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। গত ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সিঙ্গাপুর এয়ার শো-২০২৪–এ চীন বিশ্ববাসীর সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিমানটি উপস্থাপন করে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক রুটে প্রবেশের জন্য ইতোমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সার্টিফিকেশনের আবেদন করেছে।
বর্তমানে চীনের মূল লক্ষ্য হলো যে, তাদের দেশীয় প্রযুক্তির তৈরি সি-৯১৯ যাত্রী পরিবহণ বিমানকে বিশ্বের বাণিজ্যিক এভিয়েশন মার্কেটে Boeing ও Airbus-এর উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। যদিও চীনের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এখনও পর্যন্ত একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়ে গেছে। তবে দেশটির নিজস্ব অভ্যন্তরীণ রুটে এই বিমান কিন্তু ইতোমধ্যেই তার সফল যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, সিএমজি বাংলা, গ্লোবাল টাইমস, চায়না ডেইলি
সিরাজুর রহমান, শিক্ষক ও লেখক
ডিবিসি/এএমটি