রবিবার (১১ই আগস্ট) রাতে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত আল জাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরিফ তার মৃত্যুর আগে একটি শক্তিশালী বার্তা রেখে গেছেন। এই বছরের এপ্রিলে লেখা এই বার্তাটি তার মৃত্যুর পর তার এক্স অ্যাকাউন্টের অ্যাডমিন টিম প্রকাশ করে। এতে তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তার জনগণের অবিচল কণ্ঠস্বর হয়ে থাকার শপথ করেছেন এবং গাজার মানুষের কষ্ট ও স্বাধীনতার আশার কথা বিশ্বের কাছে আমানত হিসেবে রেখে গেছেন।
মিডল ইস্ট আই প্রকাশিত বার্তাটি এখানে সম্পূর্ণ তুলে ধরা হলো:
"এটাই আমার আমার শেষ বার্তা। যদি এই কথাগুলো আপনাদের কাছে পৌঁছায়, তবে জানবেন ইসরায়েল আমাকে হত্যা করতে এবং আমার কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে সফল হয়েছে।
প্রথমত, আপনাদের ওপর শান্তি এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক। আল্লাহ জানেন, আমি আমার জনগণের সহায়ক ও কণ্ঠস্বর হওয়ার জন্য আমার সমস্ত প্রচেষ্টা এবং শক্তি দিয়েছি, যেদিন থেকে আমি জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের অলিগলিতে জীবনের জন্য চোখ মেলেছি। আমার আশা ছিল আল্লাহ আমার আয়ু দীর্ঘ করবেন, যাতে আমি আমার পরিবার ও প্রিয়জনদের নিয়ে আমাদের মূল শহর দখলকৃত আসকালান (আল-মাজদাল)-এ ফিরে যেতে পারি। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই ছিল প্রথম এবং তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
আমি ব্যথার সমস্ত স্তর পার করেছি, বহুবার কষ্ট ও হারানোর স্বাদ পেয়েছি, তবুও আমি একবারের জন্যও সত্যকে তার আসল রূপে প্রকাশ করতে দ্বিধা করিনি। কোনো বিকৃতি বা মিথ্যাচার ছাড়াই। যাতে আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হন যারা নীরব ছিল, যারা আমাদের হত্যাকাণ্ডকে মেনে নিয়েছিল, যারা আমাদের শ্বাসরোধ করেছিল এবং যাদের হৃদয় আমাদের শিশু ও নারীদের ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষেও বিচলিত হয়নি; দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের জনগণ যে গণহত্যার মুখোমুখি হয়েছে তা বন্ধ করার জন্য কিছুই করেনি।
আপনাদের কাছে আমি ফিলিস্তিনকে আমানত হিসেবে রেখে গেলাম। মুসলিম বিশ্বের মাথার মুকুট, এই বিশ্বের প্রতিটি মুক্ত মানুষের হৃদস্পন্দন।
আপনাদের কাছে আমি এর জনগণকে, এর নির্যাতিত ও নিষ্পাপ শিশুদের আমানত রাখলাম, যারা কখনো স্বপ্ন দেখার বা নিরাপত্তা ও শান্তিতে বাঁচার সুযোগ পায়নি। তাদের পবিত্র দেহ হাজার হাজার টন ইসরায়েলি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের নিচে পিষ্ট হয়েছে, ছিন্নভিন্ন হয়ে দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়েছে।
আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, কোনো শৃঙ্খল যেন আপনাদের নীরব না করে, কোনো সীমান্ত যেন আপনাদের আটকে না রাখে। এই ভূমি ও তার জনগণের মুক্তির জন্য আপনারা সেতু হয়ে উঠুন, যতক্ষণ না আমাদের চুরি হয়ে যাওয়া স্বদেশে মর্যাদা ও স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়।
আপনাদের কাছে আমার পরিবারের দায়িত্ব দিলাম। আমার প্রিয় কন্যা শাম, আমার চোখের মণি, যাকে আমি স্বপ্নের মতো বড় হতে দেখার সুযোগ পেলাম না।
আমার প্রিয় মা-কে আপনাদের কাছে আমানত রাখলাম, যার দোয়া আমাকে আজ এখানে এনেছে, যার মোনাজাত ছিল আমার দুর্গ এবং যার আলো আমার পথ দেখিয়েছে। আমি দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে শক্তি দেন এবং আমার পক্ষ থেকে তাকে উত্তম প্রতিদান দেন।
আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, সর্বশক্তিমান আল্লাহর পরে আপনারা তাদের পাশে দাঁড়াবেন, তাদের সহায়ক হবেন।
যদি আমি মারা যাই, তবে আমি আমার নীতির ওপর অবিচল থেকেই মারা যাব। আমি আল্লাহর সামনে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি তাঁর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে আমি নিশ্চিত এবং আমি আশ্বস্ত যে, যা আল্লাহর কাছে আছে তা-ই উত্তম ও চিরস্থায়ী।
হে আল্লাহ, আমাকে শহীদদের মধ্যে কবুল করে নাও, আমার অতীত ও ভবিষ্যতের পাপ ক্ষমা করে দাও এবং আমার রক্তকে এমন এক আলোতে পরিণত করো, যা আমার জনগণ ও পরিবারের জন্য স্বাধীনতার পথকে আলোকিত করবে। যদি আমার কোনো ত্রুটি হয়ে থাকে, তবে আমাকে ক্ষমা করে দিও এবং আমার জন্য রহমতের দোয়া করো, কারণ আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি, কখনো বদলাইনি বা বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।
গাজাকে ভুলবেন না... এবং ক্ষমা ও কবুলিয়াতের জন্য আপনাদের আন্তরিক দোয়ায় আমাকেও ভুলবেন না।"
ডিবিসি/এমএআর