আন্তর্জাতিক, এশিয়া

ইতিহাস নির্মাতা এক মহাপুরুষ ইমাম খোমেইনী (রহ.)

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ডিবিসি নিউজ

সোমবার ১৯শে মে ২০২৫ ০৭:১৭:৩৩ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

ইতিহাসে কিছু মানুষ থাকেন, যারা শুধু একটা সময় নয়, গোটা যুগের চিন্তাধারা পাল্টে দেন। এমনই একজন ছিলেন ইমাম খোমেইনী (রহ.) একজন আধ্যাত্মিক নেতা, সাহসী বিপ্লবী ও মানবতার জন্য নিবেদিত পথপ্রদর্শক।

শুধু ইরান নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসলমান আর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষ আজও গভীর শ্রদ্ধায় স্বরণ করে একজন মানুষকে, যিনি বদলে দিয়েছেন ইতিহাসের ধারা। তিনি ইমাম খোমেইনী (রহ.) একজন আধ্যাত্মিক নেতা, সাহসী বিপ্লবী, চিন্তাবিদ আর সত্যিকার অর্থে মানুষের জন্য নিবেদিত একজন পথপ্রদর্শক। তাঁর চিন্তা, তাঁর কাজ আর তাঁর জীবন আমাদের শেখায় বিশ্বাস আর সাহস থাকলে একা একজন মানুষও গোটা সমাজের চেহারা পাল্টে দিতে পারেন।

 

ইমাম খোমেইনীর উত্থান ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন না, বরং তিনি আল্লাহর উপর ভরসা আর মানুষের ভালোর জন্য আত্মত্যাগ এর ধারণা নিয়ে এগিয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, যদি জনগণ সৎ উদ্দেশ্যে এক হয়, আর আল্লাহর সাহায্যে ভরসা রাখে তাহলে বড় বড় শক্তিকেও হারানো যায়। আর সেটাই তিনি করে দেখিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে ইরান থেকে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্র চলে যায়, আসে ইসলামি প্রজাতন্ত্র। সেসময় বিশ্ববাসী দেখেছে, ধর্ম, ন্যায়ের লড়াই আর নেতৃত্ব একসাথে কীভাবে ইতিহাস গড়ে।

 

ইমাম খোমেইনীর চিন্তা ছিল ধর্ম আর রাজনীতি একসাথেই চলবে, আলাদা করে নয়। তিনি কোরআন আর রাসুলুল্লাহ (সা.) এর আদর্শকে সামনে রেখে এমন এক শাসনব্যবস্থা তৈরি করেন যেখানে মানুষ যেন শুধু দুনিয়ার নয়, আখিরাতের দিক থেকেও সুশাসনের আলো পায়। তিনি দিনের বেলায় বড় বড় বিশ্বশক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, আবার রাতে নিঃশব্দে সেজদায় কাঁদতেন। তিনি ছিলেন এমন একজন নেতা, যিনি তাঁর জাতিকে তাদের আত্মপরিচয় ও আত্মসম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

 

১৯৭৯ সালে তাঁর নেতৃত্বে ইরানে যে বিপ্লব হয়, তা শুধু একটা দেশের ভিত পাল্টে দেয় না বরং পুরো মুসলিম দুনিয়ার জন্য নতুন এক পরিচয়ের দিকও খুলে দেয়। তাঁর স্লোগান ছিল, 'না পূর্ব, না পশ্চিম শুধু ইসলামি প্রজাতন্ত্র।' এর মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দেন, ইসলাম মানে শুধু মসজিদে ইবাদত নয়, বরং জীবন চালানোর, সমাজ গড়ার আর ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার এক পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি।

 

তিনি 'বেলায়াতে ফকীহ' নামের যে ভাবনা তুলে ধরেন, তা হলো ইমাম মাহদী (আ.) গায়েব থাকলে একজন যোগ্য, ন্যায়বান আলেম পুরো রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতে পারেন। এই ভাবনার ভিত্তিতেই গড়া হয় ইরানের শাসনব্যবস্থা, যেখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ আর গণতন্ত্র একসাথে পথ চলে। তিনি প্রমাণ করে দেন যে, ইসলামি নীতিতে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনা শুধু সম্ভব নয়, বরং তা আরও কার্যকর ও মানবিক হতে পারে।

 

ইমাম খোমেইনীর প্রভাব ছিল শুধু ইরানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক জোরালো কণ্ঠ। তিনি ইসরাইলকে 'একটি ক্যানসার টিউমার' বলেছিলেন এবং মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর ডাকে চালু হয় 'আন্তর্জাতিক কুদ্স দিবস', যা আজও অনেক দেশে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানাতে পালন করা হয়।

 

ব্যক্তিগত জীবনেও ইমাম খোমেইনী ছিলেন দারুণ সরল একজন মানুষ। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অগাধ জ্ঞানী, পিতা হিসেবে স্নেহশীল, এবং একজন সাধক হিসেবে ছিলেন একনিষ্ঠ ইবাদতকারী। ক্ষমতার মোহ, বিলাসিতা বা গর্ব এসব তাঁর মধ্যে ছিল না। তিনি যেমন নেতৃত্ব দিয়েছেন দৃঢ় হাতে, তেমনি ছিলেন বিনয়ী ও নৈতিকতায় ভরা একজন মানুষ।

 

১৯৮৯ সালের ৪ জুন তিনি ইন্তেকাল করেন, কিন্তু তাঁর আদর্শ, তাঁর চিন্তা, আর তাঁর গড়ে দেওয়া পথ আজও অনেক মানুষকে আলো দেখাচ্ছে। তাঁর উত্তরসূরি আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর নেতৃত্বে ইরান এখনো সেই ভাবনাকেই ধারণ করে এগিয়ে চলেছে। শুধু ইরানে নয়, মুসলিম দুনিয়ার নানা কোণে তাঁর আদর্শ জাগরণ, আত্মমর্যাদা আর প্রতিরোধের উৎস হয়ে আছে।

 

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি শুধু একটা বিপ্লব ঘটাননি, বরং প্রমাণ করে গেছেন—আল্লাহর উপর ভরসা, সৎ নেতৃত্ব আর জনগণের শক্তি এক হলে নতুন ইতিহাস গড়া যায়। তাঁর জীবন ও চেতনা আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যিকারের নেতৃত্ব মানে মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা, আল্লাহর নির্দেশ মানা এবং সাহসের সাথে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়া।

 

ডিবিসি/নাসিফ

আরও পড়ুন