ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষের উত্তাপে মধ্যপ্রাচ্য যেন বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছে। সেই বারুদের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশটি হলো হরমুজ প্রণালী—বিশ্ব জ্বালানির শিরা। ইরান যখন ঘোষণা দিল যে ইসরায়েলের হামলার জবাবে তারা হরমুজ কার্যত বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন এটা ছিল কেবল একটি প্রতিক্রিয়া নয়, বরং জিও-অর্থনৈতিক যুদ্ধের সূচনা।
এই মুহূর্তে প্রশ্ন হলো—এই সংঘাত কি এক আঞ্চলিক উত্তেজনায় সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বিশ্ব অর্থনীতিকে একটি নতুন সংকটচক্রে ঠেলে দেবে?
হরমুজ: বিশ্বব্যবস্থার নাভিমূল
প্রথমেই বোঝা দরকার, হরমুজ প্রণালী কেবল একটি ভৌগোলিক স্থান নয়, বরং বিশ্ব অর্থনীতির অনিবার্য শ্বাসনালি। প্রতিদিন প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই পথ দিয়ে বহন হয়, যার গন্তব্য এশিয়া, ইউরোপ, এমনকি আমেরিকাও। একে ঘিরে তৈরি হয়েছে তেলের বাজার, শেয়ারবাজারের মানসিকতা, বৈদেশিক মুদ্রা নীতি এমনকি বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্যও। ইরান ঠিক এই কেন্দ্রে আঘাত হেনেছে—যা সামরিক প্রতিশোধের চেয়ে অনেক গভীর এক কৌশলগত চাল।
অর্থনৈতিক ভূকম্পন: কেবল শুরু
ইরানের এই পদক্ষেপ বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য হঠাৎ ৭–১৪ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এটি কেবল প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। বাজার যত দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার হিসাব কষবে, তত বাড়বে মূল্য, তত ছড়িয়ে পড়বে এর প্রভাব খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে নির্মাণ পর্যন্ত। মূল প্রশ্ন হলো—এই সংকট কতদিন স্থায়ী হবে? ইতিহাস বলছে, হরমুজে সংকট যত দীর্ঘ হয়, বাজার তত অস্থির হয়। ১৯৮০-এর ‘ট্যাংকার যুদ্ধ’–এর সময় আমরা একই প্রভাব দেখেছি, আর এখন পরিস্থিতি আরও জটিল। ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্বমুদ্রাস্ফীতির পরে এই ধাক্কা বিশ্ব অর্থনীতির পক্ষে মারাত্মক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর দোদুল্যমানতা
বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি ইতিমধ্যেই সুদের হার কমানোর বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। এমন এক সময়ে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এই তেল সংকট আবার আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করছে। সুদের হার কমানোর পথ হয়তো আবার থেমে যাবে, যা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ফলে, বাজারের আশা ভরসা—একটি ‘সফট ল্যান্ডিং’—এখন নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ।
সামরিক উত্তেজনা ও বাণিজ্য পথের নিরাপত্তা
প্রণালীর নিরাপত্তা এখন আর কেবল জাহাজের নয়, বরং আন্তর্জাতিক নীতিরও বড় পরীক্ষা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই EMASoH ও Aspides মিশনের মাধ্যমে টহল বাড়িয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ পারস্য উপসাগরে সক্রিয় হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—সামরিক উত্তেজনা কি সত্যিই এই চোকপয়েন্টকে নিরাপদ রাখতে পারবে? আর যদি উত্তেজনা আরও বাড়ে—ইরান যদি পুরোপুরি ট্যাংকার আটকে দেয়, বা হুথিদের মতো যোদ্ধা গোষ্ঠীগুলোও এ পথে হামলায় যুক্ত হয়—তাহলে এই সংকট সামাল দেওয়ার মতো প্রস্তুতি বিশ্ব নেতাদের কি আছে?
বিকল্প পথ ও বাস্তবতা
অনেকে বলছেন, সৌদি আরব ও আমিরাতের বিকল্প পাইপলাইন এই চাপ কমাবে। সত্য হলো, সেই রুটগুলোর পরিবহন ক্ষমতা সীমিত, এবং ভূরাজনৈতিকভাবে সেগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্ব আজও হরমুজের বিকল্প তৈরি করতে পারেনি। ফলে, ইরান জানে—এই পথ বন্ধ করা মানেই সমগ্র বিশ্বকে একটি ব্যথার কেন্দ্রবিন্দুতে বেঁধে ফেলা।
ভূরাজনৈতিক বার্তা: পশ্চিমা নীতির পুনঃমূল্যায়ন
ইরানের এই পদক্ষেপ সরাসরি একটি বার্তা—যে মধ্যপ্রাচ্যকে সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা যদি পশ্চিমারা অব্যাহত রাখে, তবে তার মূল্য শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বাজারেও চুকাতে হবে। বিশ্বরাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে যে শক্তির ভারসাম্য ছিল—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের পক্ষে—এই ধরনের কৌশলগত প্রতিক্রিয়া সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিশেষত, রাশিয়া ও চীনের মতো শক্তিগুলো এখন এই ঘটনার কূটনৈতিক ফায়দা তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য এই সংকট আরও সংবেদনশীল। আমাদের আমদানি বিলের বড় অংশ জ্বালানির পেছনে, যার অর্থ তেলের দাম বাড়লেই সরাসরি প্রভাব পড়ে ডলার রিজার্ভে, মুদ্রাস্ফীতিতে এবং পণ্যমূল্যে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নীতি নির্ধারকদের জন্য এখন সময় সতর্কভাবে ব্যয় কাঠামো মূল্যায়ন করার। বিকল্প জ্বালানি উৎসের দিকে মনোযোগ বাড়ানো এবং বৈদেশিক বাণিজ্য চুক্তিগুলোকে বহুমুখীকরণ করাই এখন সময়ের দাবি।
উপসংহার
ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে যেটি দেখিয়েছে, তা একটি সামরিক প্রতিশোধ নয়—বরং বিশ্ব অর্থনীতিকে তার কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার এক অসাধারণ ঘুঁটি। এই সংকট যত দীর্ঘ হবে, ততই বিশ্ব অর্থনীতি প্রবল প্রতিক্রিয়ায় কাঁপবে। একদিকে মুদ্রাস্ফীতি, অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতা—এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে আগামী সময় কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশ্ব নেতাদের জন্য এটি একটি মুহূর্ত—যেখানে কূটনৈতিক সংলাপ, আঞ্চলিক ভারসাম্য, এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্যে একটি সমন্বয় খুঁজে বের করতেই হবে। হরমুজ এখন কেবল একটি প্রণালী নয়, এটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের আর্থ-রাজনৈতিক সংকটের নতুন কেন্দ্রবিন্দু।
ডিবিসি/এএনটি