বর্তমানে আমাদের সমাজে বা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল বা গরীব তাদের আমরা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। বিভিন্ন সময়ে আমাদের এই অসহায় ও দরিদ্র স্বজনদের লোক দেখানো কিছু দান বা অনুদান প্রদান করলেও বাস্তবে তাদের কাজে লাগে কিংবা অভাব দূর হয় এমন পরিমাণ আর্থিক সহায়তা বা ঋণ হিসেবে হলেও প্রদান করা থেকে অনেকেই বিরত থাকে। এমনকি অনেক ধনী ও আর্থিকভাবে সচ্ছল আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে অভাবগ্রস্ত কেউ আর্থিক সহায়তা বা ঋণের জন্য আসলে মনে মনে খুবই বিব্রত বা অখুশি হন।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তা’লা ঘোষণা করেন যে, ‘আর আত্মীয়-স্বজনকে তার হক দিয়ে দাও এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। কিছুতেই অপচয় করো না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ২৬-২৭)
বর্তমানে আমাদের এই নিষ্ঠুর সমাজের কিছু মানুষ শুধু নিজের পরিবার ও পরিজন নিয়েই খুব ব্যস্ত থাকে। নিকট আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ থাকে উদাসীন। আবার সমাজে দেখা যায় যে, নিজের আর্থিক সক্ষমতা বা ধন সম্পদ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই রক্তের সম্পর্কের দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে যান। অন্যদিকে স্বল্প পরিচিত কিংবা কথিত বন্ধুদের খুশি করতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেন। এ কারণেই মহান আল্লাহ তা’লা পবিত্র কোরআনে সুরা বনি ইসরাইলের ২৬-২৭ নম্বর আয়াত দ্বারা প্রথমে রক্তের সম্পর্কের বা নিজের আত্মীয়-স্বজনদের হক আদায় করার কথা বলা হয়েছে। তারপর চাহিদা মাফিক সমাজের অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরের হক আদায় করা ফরজ করে দিয়েছেন।
পবিত্র হাদিস শরিফে হজরত বুরায়দা (রা.) বর্ণনা করেন যে, আমি আল্লাহর রাসুল থেকে বলতে শুনেছি যে,
‘ مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا فَلَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ مِثْلُهُ صَدَقَةٌ ’
অর্থ- যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে (ঋণ আদায়ে) অবকাশ দিবে সে প্রতিদিন ওই পরিমাণ সম্পদ সদকার সাওয়াব পাবে।
قَالَ : ثُمَّ سَمِعْتُهُ يَقُولُ : " مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا فَلَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ مِثْلَيْهِ صَدَقَةٌ
হজরত বুরায়দা (রা.) আরো উল্লেখ করেন যে, অতঃপর আমি আল্লাহর রাসুলকে আবারও বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে (ঋণ আদায়ে) সুযোগ দিবে সে প্রতিদিন উক্ত ঋণের দ্বিগুণ পরিমাণ সম্পদ সদকার সাওয়াব পাবে।
অর্থাৎ, এখানে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজে আমরা কোনো দরিদ্র ব্যক্তিকে এক হাজার টাকা ঋণ দিয়ে তাকে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত পরিশোধে সময় দিলে ঋণ প্রদানকারী ব্যক্তি প্রতিদিন তার দ্বিগুণ সমপরিমাণ অর্থ দানের সাওয়াব পেতে থাকবেন। আর এ থেকেই মূলত পবিত্র ইসলামের এক সুন্দর, মানবিক এবং বৈষম্যহীন সৌন্দর্য আমাদের সামনে প্রকাশ পেয়েছে।
তাছাড়া হাদিসে আরো বর্ণিত হয় যে, ‘قُلْتُ : سَمِعْتُكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ تَقُولُ: " مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا فَلَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ مِثْلُهُ صَدَقَةٌ "، ثُمَّ سَمِعْتُكَ تَقُولُ : " مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا فَلَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ مِثْلَيْهِ صَدَقَةٌ’ অর্থ- আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি আপনাকে একবার বলতে শুনলাম, যে ব্যক্তি অভাবীকে ঋণ আদায়ে অবকাশ দিবে সে প্রতিদিন ওই পরিমাণ সম্পদ সদকার সাওয়াব পাবে। এরপর আবার বলতে শুনলাম, যে ব্যক্তি অভাবীকে (ঋণ আদায়ে) সুযোগ দিবে সে প্রতিদিন উক্ত ঋণের দ্বিগুণ পরিমাণ সম্পদ সদকার সাওয়াব পাবে।
قَالَ لَهُ : بِكُلِّ يَوْمٍ صَدَقَةٌ قَبْلَ أَنْ يَحِلَّ الدَّيْنُ، فَإِذَا حَلَّ الدَّيْنُ فَأَنْظَرَهُ فَلَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ مِثْلَيْهِ صَدَقَةٌ
তখন আল্লাহর রাসুল বললেন, ঋণের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন ঋণের সমপরিমাণ দানের সাওয়াব হবে । অতঃপর যখন মেয়াদ পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর ঋণ পরিশোধে অক্ষমতা প্রকাশ করবে। তখন যদি ঋণদাতা আবার সময় বাড়িয়ে দেয়, তাহলে সে প্রতিদিন দ্বিগুণ পরিমাণ সাওয়াব পাবে। (মুসনাদে আহমাদ: ২৩০৪৬)
পরিশেষে বলা যায় যে, মহান আল্লাহর শান্তির ধর্ম ইসলামে সকলের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে জোর তাগিদ দিয়েছেন। পবিত্র আল কোরআন ও হাদিসের আলোকে নিজের আত্মীয়-স্বজনের পাশাপাশি সমাজের চরম অসহায় ও দরিদ্র মানুষদের নিজের সাধ্যের মধ্যে আর্থিক সহায়তা বা ক্ষেত্রবিশেষে সুদমুক্ত ঋণ প্রদান এবং তা পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তিকে আরো সময় দেয়াকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সওয়াবের কাজ হিসেবে বিবেচনা করেন ইসলামি চিন্তাবিদেরা। যা আমাদের নিজেদের জীবনে সক্ষমতা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করলে একটি সুন্দর, বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ এবং অভাবমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।
ডিবিসি/এএনটি