বিবিসির প্রতিবেদন

ইয়েমেনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ভারতীয় নার্সের বিচারে কিসাসই চায় নিহতের পরিবার

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ডিবিসি নিউজ

শনিবার ১৯শে জুলাই ২০২৫ ১০:৩৪:৫৩ পূর্বাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়া যে ইয়েমেনি নাগরিককে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা পেয়েছেন, সেই তালাল আব্দো মাহদির ভাই বিবিসিকে বলেছেন যে মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো শাস্তিই তারা মানতে রাজি নন।

বিবিসি অ্যারাবিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আব্দেলফাতাহ্ মাহদি বলেছেন, “মীমাংসার ব্যাপারে আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট। আল্লাহর তৈরি আইন 'কিসাস'-ই কার্যকর করতে হবে, অন্য কোনো কিছু নয়।”

 

আব্দেলফাতাহ্ মাহদি বিবিসি অ্যারাবিককে ওই সাক্ষাৎকার দেওয়ার পরে অবশ্য নিমিশা প্রিয়ার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা আপাতত স্থগিত করেছে ইয়েমেনের কর্তৃপক্ষ। বুধবার ওই সাজা কার্যকর করার কথা ছিল।


এর আগে ক্ষতিপূরণ হিসাবে নিমিশা প্রিয়া’র আত্মীয়স্বজন ও সমর্থকরা মি. মাহদির পরিবারকে ‘ব্লাড মানি’ দিতে বা ১০ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেন এবং পরিবারকে সেটা 'অফার'ও করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

 

কিন্তু মৃতের পরিবার কোনো সমঝোতাতেই রাজি নয় বলে স্পষ্ট জানিয়েছে এবং তারা ক্ষমা না করলে নিমিশা প্রিয়ার প্রাণ কোনোভাবে বাঁচানো সম্ভব নয়।


মৃত তালাল আব্দো মাহদি ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়ার ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন। ২০১৭ সালে তালাল আব্দো মাহদির টুকরো টুকরো করা দেহ একটি জলের ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয়।

 

এরপরই সেই হত্যার অভিযোগে নিমিশা প্রিয়াকে গ্রেপ্তার হতে হয় এবং সে দেশের আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

 

'কিসাস' কী?

 

'কিসাস' একটা আরবি শব্দ। এর অর্থ প্রতিশোধ বা বদলা নেওয়া।

 

ইসলামি আইন অনুযায়ী, শারীরিক আঘাত সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতিই 'কিসাস'। নারী ও পুরুষ – উভয়ের ক্ষেত্রেই এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।

 

সহজ কথায়, কিসাস হলো প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ নেওয়া। অর্থাৎ একজনকে যতটা আঘাত করা হয়েছে, অপরাধীকেও ঠিক ততটাই আঘাত পেতে হবে।

 

আইনজীবী মুফতি ওসামা নদভি বিবিসি হিন্দিকে জানিয়েছেন, “কিসাস হলো ন্যায়বিচারের ইসলামি নীতি। ইচ্ছাকৃত হত্যা বা আঘাত করার সমপরিমাণ শাস্তি দেওয়াই ন্যায়বিচার।”

 

তিনি বলছিলেন, “কিসাস শব্দটা আরবি, যার আক্ষরিক অর্থ হলো ধাওয়া করা বা পিছু নেওয়া। কুরআনে একাধিকবার কিসাস-এর উল্লেখ রয়েছে।”

 

আবার 'কিসাস' অনুযায়ী ক্ষমা করাও সঙ্গত, কিন্তু একমাত্র পীড়িত পরিবার চাইলেই তা সম্ভব।

 

নদভি বলছিলেন, “যদি কেউ চোখ উপড়িয়ে নেয়, তাহলে কিসাস হলো অপরাধীরও চোখ উপড়িয়ে নেওয়া হবে। যে যেরকম অপরাধ করেছে, তার সাজা হবে ঠিক সেই একই। এই নীতি অনুযায়ী নারী ও পুরুষদের একই শাস্তির বিধান আছে।”

 

“তবে নারীদের ক্ষেত্রে মানবিক কিছু ছাড়ও দেওয়া হয়। যেমন কোনো নারী যদি হত্যা করে থাকেন এবং তিনি যদি নিজের সন্তানকে স্তন্যপান করানোর পর্যায়ে থাকেন, তাহলে সেই শিশু কিছুটা বড় হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওই নারীর শাস্তি স্থগিত রাখা হবে।”

 

তার কথায়, এটা কোনো একটি দেশের আইন নয়, এটা কুরআনের আইন। তবে এই আইন কার্যকর করতে গেলে কোনো দেশকে ইসলাম ও শরিয়া অনুযায়ী চলতে হবে।

 

শরিয়া আইন চালু না থাকলে সাজার এই পদ্ধতি বলবত করা যায় না বলে জানিয়েছেন নদভি।

 

নিমিশা প্রিয়ার পুরো ঘটনাটি কী?

 

কেরালার পালাক্কর জেলার বাসিন্দা নিমিশা নার্সের চাকরি নিয়ে ২০০৮ সালে ইয়েমেনে গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পর স্বামী টমি থমাস এবং মেয়ের সঙ্গেই থাকছিলেন নিমিশা। পরে ২০১৪ সালে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তার স্বামী এবং ১১ বছরের মেয়ে ভারতে ফিরে এলেও নিমিশা সেখানেই থেকে যান। তার ইচ্ছা ছিল, ইয়েমেনে নিজের ক্লিনিক খুলবেন।

 

২০১৪ সালে ইয়েমেনি নাগরিক তালাল আব্দো মাহদির সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। মাহদি তাকে নতুন ক্লিনিক খুলতে সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দেন। কারণ আইন অনুযায়ী, ইয়েমেনে নতুন ব্যবসা শুরু করতে গেলে দেশীয় অংশীদার রাখা বাধ্যতামূলক। সেই মতো ২০১৫ সালে দু’জন মিলে নতুন ক্লিনিক খোলেন; কিন্তু  এর পর থেকেই শুরু হয় দুই অংশীদারের মতবিরোধ।

 

অভিযোগ, নিমিশার অর্থ এবং পাসপোর্ট মাহদি কেড়ে নিয়েছিলেন মাহদি। মারধর করে নিমিশাকে মাদকসেবনেও বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে মাহদির বিরুদ্ধে। আইনি কাগজপত্রে নিমিশাকে স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিয়ে প্রশাসনিক সাহায্য পাওয়ার পথও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও লাভ হয়নি।

 

এই পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই মাহদিকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেন ওই নার্স। নিমিশার দাবি, মাহদিকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের পাসপোর্ট পুনরুদ্ধার করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। কিন্তু ওভারডোজ়ের কারণে মৃত্যু হয় মাহদির। এর পর হানান নামে এক সহকর্মীর সঙ্গে মিলে মাহদির দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে পানির ট্যাঙ্কে ফেলে দেন ওই নার্স। ওই মাসেই ইয়েমেন ছেড়ে পালানোর সময় ধরা পড়ে যান নিমিশা। সেই থেকে ইয়েমেনের জেলেই বন্দি রয়েছেন এই ভারতীয় নারী।

 

নিমিশার মা একজন দরিদ্র গৃহকর্মী। মেয়েকে রক্ষা করতে ২০২৪ সাল থেকে ইয়েমেনে আছেন তিনি।

 

নিহত তালাল আব্দো মাহদির পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা বলা ও আলাপ-আলোচনার জন্য ইয়েমেনের একজন সমাজকর্মী স্যামুয়েল জেরোমকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছেন।

 

নিমিশা প্রিয়ার প্রাণ বাঁচানোর জন্য 'সেইভ নিমিশা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল' নামে একটি লবি গ্রুপও গড়ে তোলা হয়েছে, ভারতে ও ভারতের বাইরে থেকে নানা দেশ থেকে তারা ক্রাউডফান্ডিং-এর মাধ্যমে অর্থও সংগ্রহ করছেন।

 

তথ্যসূত্র বিবিসি বাংলা

 

ডিবিসি/এমইউএ

আরও পড়ুন