বিশ্বদরবারে নিজেদের ইমেজ তুলে ধরার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছে কাতার। স্টেডিয়াম নির্মাণ, আবাসন, বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন, সর্বোপরি আগত ফুটবল পর্যটকদের মন মাতাতে ২০০ বিলিয়নের ওপর ডলার খরচ করেছে। কাতার ২০২২ ওয়েবসাইটে ঢুকলেই যার কিছু নমুনা চোখে পড়বে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরাসরি সেসবে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে বিশ্বকাপ পর্যটকদের।
কাতার কি কেবল বিনোদনের লক্ষ্যে এত এত ডলার খরচ করেছে? এই প্রশ্নের উত্তরে রয়টার্সকে কাতারের একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, কাতার তার মাটিতে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্বকাপকে কেবল একটি ক্রীড়া ইভেন্টের চেয়ে অনেক বেশি কিছু মনে করে। দেশটি মনে করে, এটি তার জন্য একটি প্রধান ‘বিপণন লঞ্চ প্যাড’ হিসাবে কাজ করবে।’
ওয়াশিংটনের মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো কারেন ইয়াং বলেন, এটি একটি একটি দুর্দান্ত বিপণন। যা পর্যটন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে।
কাতার আশা করছে, এই বিশ্বকাপ মৌসুমে দেড় মিলিয়ন পর্যটক পাবে তারা। দোহা এবং অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থাগুলির আশ্বাস অনুযায়ী, শুধুমাত্র পর্যটন খাত থেকে উৎপন্ন রাজস্ব প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়নে পৌঁছবে। বিশ্বকাপের সাথে যুক্ত পর্যটন ব্যয় এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম দেশের জিডিপিতে ১.৫% যোগ করবে। এই প্রেক্ষাপটে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আশা করেছিল যে, কাতারি অর্থনীতি এই বছর ৩.৪% হারে বৃদ্ধি পাবে এবং আগামী বছরগুলিতে ৪.৪% হারে বৃদ্ধি পাবে। কারণ, বিশ্বকাপ আয়োজনের পর দেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিকাশ ঘটবে। কাতারের লক্ষ হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ৬ মিলিয়ন পর্যটক নিয়ে আসা।
বিশ্বকাপের পর কাতারে পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপের ফলে একটি দুর্দান্ত পর্যটন-সুবিধা পেয়েছিল দেশটি। ২০১৯ সালে বছরে দেশটির পর্যটক হয়েছিল ১০ মিলিয়ন। যা মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশ।
আমেরিকান ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট ম্যাগাজিনের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কাতার বিশ্বকাপ উপলক্ষে এতকিছু উন্নত করেছে বিশ্বকাপ শেষে স্থানীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে। ব্যবসা, পরিবহন ও বাণিজ্য উদ্যোগের পরিধি সম্প্রসারণ করতে।
কাতারের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক অ্যালেক্সিস আন্তোনিয়াদেস বলেছেন, এখন কাতারের সময় এসেছে বিশ্বের সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করার, প্রতিভা এবং কোম্পানিকে আকর্ষণ করার, সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ এবং পর্যটকদের আকর্ষণ করার।
ধনী দেশ কাতার। মাথাপিছু আয় প্রায় ৯৫ লাখ টাকা। দোহার স্কাইলাইন দেখলে মনে হবে নিউ ইয়র্ক। পরিচ্ছন্নতায় আরো ঝকঝকে। অন্য দেশের মুভেনপিকও দোহারটির মতো ‘এলিট’ নয়। পর্যটকরা জানেন, দেশভেদে একই চেইন হোটেলের চাকচিক্যে কতটা হেরফের হয়। আকাশছোঁয়া কাচঘেরা দালান থেকে দৃষ্টি নামালেই চোখে পড়বে বিশ্বের সবচেয়ে দামি মডেলের স্পোর্টস কার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এমনিতে ট্রাফিক আইনে বেশ কড়াকড়ি। কিন্তু স্থানীয়দের বেলায় এমন শৈথিল্যের তাৎপর্য নিশ্চয় আছে। কী হতে পারে। স্রেফ অনুমান—অঢেল সম্পদ বুঝি আইনকেও নিজের সুবিধামতো সাজানোর অধিকার দেয়!
জেরম ভালকে এই ‘তাৎপর্য’ খুব ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ২০১০ সালের বিডিংয়ে ইংল্যান্ডসহ আরো কয়েকটি দেশকে টপকে ২০১৮ বিশ্বকাপ রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশকে পেছনে ফেলে কাতারের ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার দিন থেকেই বিস্তর সমালোচনা হয়েছে বিশ্ব ফুটবল সংস্থার (ফিফা)। ভালকে তখন ফিফার সেক্রেটারি জেনারেল। অনন্যোপায় হয়ে যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘রাশিয়া ও কাতার যা পারে, তা অন্য কোনো দেশের পক্ষে সম্ভব না।’ সত্যিই সম্ভব না। কারণ, আর সব দেশের মতো জনগণের কাছে জবাবদিহিতার বালাই নেই রাশিয়া কিংবা কাতারের।
বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার বিডিংয়ে যে ভোট কেনাবেচা হয়েছে, সেই গুঞ্জন সত্যি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টে। ভালকে ফুটবলে নিষিদ্ধ হয়েছেন ২০২৮ সাল পর্যন্ত। পদ হারিয়েছেন ফিফার তৎকালীন এক সহসভাপতিসহ আরো জনাতিনেক ঊর্ধ্বতন। তাতে কাতারের আয়োজক হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যেতে বসেছিল। কিন্তু ফিফার সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ডের আইনের ফাঁকতালে দায়মুক্তি পেয়েছে রাশিয়া ও কাতার। ২০১৮ সালে আয়োজক রাশিয়া মুগ্ধ করেছে গোটা ফুটবলবিশ্বকে। নিশ্চিতভাবে আরো বড় চমক দেখাচ্ছে কাতার।
জোড়া চমক অবশ্য বিডিংয়ের পরপরই দিয়ে ফেলেছে কাতার। একটি বিশ্বকাপও না খেলা প্রথম দেশ হিসেবে ফুটবলের বৈশ্বিক আসর আয়োজন করছে। দ্বিতীয়ত, চিরায়ত জুন-জুলাই বাদ দিয়ে এবার নভেম্বর-ডিসেম্বরে হচ্ছে ফুটবল বিশ্বকাপ। তাতে পুরো বিশ্বের ফুটবল ক্যালেন্ডারে প্রভাব পড়েছে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম ছাড়াই দীর্ঘ ঘরোয়া মৌসুমের মাঝপথে মেসি-রোনালদোদের নামতে হবে ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে। চোট এরই মধ্যে অনেকের বিশ্বকাপ শেষ করে দিয়েছে। আরো কত চোট ওঁত পেতে আছে, কে জানে।