আন্তর্জাতিক, ভারত

জাহাজ আসে না, কাজ নেই; ভারতে বন্ধের পথে বিশ্বের বৃহত্তম শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড আলাং

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ডিবিসি নিউজ

সোমবার ১৫ই ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:০৫:৩২ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

গুজরাটের ভাবনগর জেলার উপকূলীয় শহর আলাং। আরব সাগরের তীরে অবস্থিত এই স্থানটি বিশ্বের বৃহত্তম শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড হিসেবে পরিচিত। একসময় যেখানে সাগরের দিগন্তরেখা ঢাকা পড়ে থাকত বিশাল সব জাহাজের ভিড়ে, আজ সেখানে শুধুই শূন্যতা। রামকান্ত সিংয়ের মতো প্রবীণ শ্রমিকরা, যারা দুই দশক ধরে বিশাল সব অয়েল ট্যাঙ্কার আর কার্গো ক্যারিয়ার কাটার কাজ করেছেন, তারা এখন তাকিয়ে থাকেন ফাঁকা সমুদ্রের দিকে। একসময় ঝড়ের আগে মোষের পালের মতো জাহাজ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকত এখানে, আর এখন তা আঙুলে গুনে ফেলা যায়।

ভারতের মোট জাহাজ ভাঙার ৯৮ শতাংশ এবং বৈশ্বিক শিপ রিসাইক্লিংয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কাজ হতো এই আলাংয়ে। কিন্তু বর্তমানে তীব্র মন্দায় ধুঁকছে এই শিল্প। শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ সালে যেখানে রেকর্ড ৪১৫টি জাহাজ এখানে ভাঙা হয়েছিল, ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২৪-এ। একসময়ের কর্মচঞ্চল ১৫৩টি প্লটের মধ্যে এখন সচল আছে মাত্র ২০টির মতো, তাও চলছে নামমাত্র ক্ষমতায়।

 

এই বিপর্যয়ের পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতির জটিল সমীকরণ। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ এবং লোহিত সাগরে হুথিদের আক্রমণের ফলে বিশ্বজুড়ে পণ্য পরিবহনের রুট ও খরচ পাল্টে গেছে। সুয়েজ খাল এড়িয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব। ফলে পুরনো জাহাজ অবসরে বা স্ক্র্যাপে না পাঠিয়ে সেগুলোকে মেরামতের মাধ্যমে সচল রাখতেই বেশি আগ্রহী হচ্ছেন জাহাজের মালিকরা। এতেই কমে গেছে আলাংয়ে আসা জাহাজের সংখ্যা।

 

সংকটের আরেকটি বড় কারণ হলো আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ ও প্রতিযোগিতা। ২০১৯ সালে হংকং কনভেনশন (HKC) মেনে ভারত পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ জাহাজ ভাঙার ব্যবস্থা জোরদার করে। এতে ইয়ার্ড মালিকদের অবকাঠামোগত খরচ ও নিরাপত্তা ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজের স্ক্র্যাপের জন্য বেশি দাম প্রস্তাব করছে। বাংলাদেশে প্রতি এলডিটি (লাইট ডিসপ্লেসমেন্ট টনেজ) যেখানে ৫৪০-৫৫০ ডলার এবং পাকিস্তানে ৫২৫-৫৩০ ডলার দেওয়া হচ্ছে, সেখানে খরচ সামলাতে হিমশিম খাওয়া ভারতীয় ইয়ার্ডগুলো ৫০০-৫১০ ডলারের বেশি দিতে পারছে না। ফলে জাহাজের মালিকরা এখন ভারতের বদলে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের দিকেই ঝুঁকছেন।

 

এই মন্দার প্রভাব শুধু ইয়ার্ডেই সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে পুরো স্থানীয় অর্থনীতিতে। আলাংয়ের আশেপাশে গড়ে ওঠা পুরনো আসবাব, চেইন, লাইফবোট, ক্রোকারিজ ও স্ক্র্যাপ মেটালের বিশাল বাজার এখন ক্রেতাশূন্য। ভাবনগরের স্টিল মিল ও রি-রোলিং মিলগুলো কাঁচামালের অভাবে ধুঁকছে। জীবিকার তাগিদে হাজার হাজার শ্রমিক এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। শ্রমিক সংগঠনের তথ্যমতে, একসময় যেখানে ৬০ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন, আজ সেই সংখ্যা কমে ১৫ হাজারের নিচে নেমে এসেছে।

 

শ্রমিকদের মতে, বর্তমানে আলাংয়ে কাজের পরিবেশ আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ ও আধুনিক। কিন্তু রামকান্ত সিংয়ের মতো শ্রমিকদের আক্ষেপ, “নিরাপত্তা বেড়েছে, কিন্তু কাজই যদি না থাকে তবে এই নিরাপত্তা দিয়ে কী হবে?” বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত এই উপকূল এখন পরবর্তী জাহাজের অপেক্ষায় দিন গুনছে, আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একসময়ের জমজমাট আলাং।

 

সূত্র: আল জাজিরা

 

ডিবিসি/পিআরএএন

আরও পড়ুন