খুতবার শাব্দিক অর্থ বক্তৃতা বা বক্তৃতা করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় খুতবা বলা হয় এমন বক্তৃতা, যাতে আল্লাহর প্রশংসা, তার একত্ববাদের ঘোষণা, হযরত রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রতি দরুদ এবং উপস্থিত সাধারণের প্রতি উপদেশ বিদ্যমান থাকে।
মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর কুবার মসজিদে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করেন। এতে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই ইমামতি করেন। এদিন জুমার নামাজের আগে তিনি দু’টি খুতবা প্রদান করেন। তখন থেকেই শুক্রবারে জুমার নামাজের জামাতের আগে দু’টি খুতবা প্রদানের প্রথা প্রচলিত।
জুমার নামাজের আগে খুতবা পাঠ নামাজেরই অংশবিশেষ। তাই খুতবা আরবিতে পাঠ করতে হয়। তবে খুতবা পাঠের আগে ইমাম সাহেবরা মাতৃভাষায় খুতবার মূল বক্তব্যটুকু বলে দিলে সবাই খুতবার সারমর্মের প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী হতে পারবে।
যেহেতু জুমার দিন মসজিদে অনেক মানুষের সমাগম হয়, তাই জুমার খুতবার আগে সমাজে প্রচলিত অন্যায়-অবিচার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদকাসক্তি, মজুতদারি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বোমাবাজি, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি সামাজিক অনাচার ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং দুর্লঙ্ঘ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অথবা গরীব-মিসকিন, অনাথ আত্মীয়স্বজন, অভাবগ্রস্ত পাড়া-প্রতিবেশী, অভুক্ত অনাহারী ও আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে সামর্থ্যবানদের সহযোগিতার দিকনির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে।
এই ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণীর সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আদর্শ জাতি গঠনে ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেন খতিব সাহেবরা। খুতবা জুমার নামাজের শর্ত বা ফরজ। খুতবা ব্যতীত জুমার নামাজ হয় না। উপস্থিত মুসল্লিদের জন্য খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব। তাই খুতবা চলাকালে নিরর্থক কাজে মশগুল থাকা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার দিন খুতবা প্রদানের সময় যদি তুমি তোমার সঙ্গীকে বলো, ‘চুপ করো’ তখন তুমি অনর্থক কথাই বললে। -সহিহ বোখারি: ১/১২৮
বর্ণিত হাদিস দ্বারা সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়, খুতবার সময় নিশ্চুপ হয়ে খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব এবং কথাবার্তা বলা হারাম। অনুরূপ খুতবার সময় সুন্নত-নফল নামাজ পড়াও বৈধ নয়। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হবেন, তখন নামাজ পড়বে না, কথাও বলবে না। -মেশকাত: ৩/৪৩২
তাই মুসল্লিদের উচিৎ খুতবার সময় কথাবার্তা থেকে বিরত থেকে অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে খুতবা শ্রবণ করা এবং যেসব কাজ নামাজে নিষিদ্ধ তা থেকে বিরত থাকা। ফিকাহ শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ 'ফাতাওয়ায়ে শামী'তে একটি মূলনীতি উল্লেখ হয়েছে, যেসব কর্ম নামাজের মধ্যে হারাম, তা খুতবা চলাকালীন সময়ও হারাম। যেমন- কথাবার্তা বলা, পানাহার করা ইত্যাদি। -ফাতাওয়ায়ে শামি: ৩/৩৫
বর্তমানে অনেক মসজিদে লক্ষ করা যায়, খুতবা চলাকালে অনেক মুসল্লি নামাজবিরোধী কর্মে লিপ্ত হয়, যা সম্পূর্ণ শরিয়ত পরিপন্থী এবং হারাম। এ ছাড়া অনেক মসজিদে খুতবা চলাকালে চাঁদার বাক্স চালানো হয়, এটা শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েজ। খুতবার সময় এসব নাজায়েজ কর্ম পরিহার করে মনোযোগী হয়ে খুতবা শ্রবণ করা অত্যন্ত জরুরি।
খুতবার কিছু সুন্নত রয়েছে, খতিবদের সেসব সুন্নত অনুসরণ-অনুকরণ করা প্রয়োজন। ফিকাহ শাস্ত্রের অন্যতম গ্রন্থ 'ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি'তে খুতবার ১৫টি সুন্নত উল্লেখ করা হয়েছে। তা হল-
এক. পবিত্রতার সঙ্গে খুতবা প্রদান করা। অজু ছাড়া বা নাপাক অবস্থায় খুতবা দেয়া মাকরুহ।
দুই. দাঁড়িয়ে খুতবা দেয়া। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হজরত জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে খুতবা প্রদান করতেন। -মুসলিম শরিফ: ১/২৮৩
তিন. মুসল্লিদের দিকে মুখ করে খুতবা পাঠ করা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মিম্বরে দাঁড়াতেন, তখন আমরা তার সম্মুখ হয়ে বসতাম। -সুনানে তিরমিজি: ১/১১৪
চার. খুতবার আগে অন্তরে 'আউজুবিল্লাহ' পাঠ করা।
পাঁচ. মুসল্লিদের খুতবা শ্রবণ করানো। অর্থাৎ খুতবা উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করা, যাতে করে মুসল্লিরা খুতবা শ্রবণ করতে পারেন।
ছয়. আল্লাহর প্রশংসার মাধ্যমে খুতবা শুরু করা।
সাত. খুতবায় আল্লাহপাকের এমন প্রশংসা করা, যার উপযুক্ত একমাত্র তিনিই।
আট. কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করা।
নয়. হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) ওপর দরুদ পাঠ করা।
দশ. ওয়াজ-নসিহত করা।
এগারো. ছোট তিন আয়াত বা বড় এক আয়াত পরিমাণ কোরআন তেলাওয়াত করা।
বারো. দ্বিতীয় খুতবায় আল্লাহপাকের প্রশংসা এবং নবী করিম (সা.) এর ওপর দরুদ পাঠ করা।
তেরো. সমগ্র পৃথিবীর মুসলিম নরনারীর জন্য দোয়া করা।
চৌদ্দ. খুতবা সংক্ষিপ্ত হওয়া। নামাজে পঠিতব্য তিওয়ালে মুফাসসল তথা দীর্ঘ সূরা রয়েছে, খুতবা সেগুলোর মধ্য থেকে যে কোনো একটির সমপরিমাণ হওয়া। হাদিস শরিফে খুতবা সংক্ষিপ্ত করার প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে।
হযরত আম্মার (রা.) বলেন, ’আমি হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, কোনো ব্যক্তির নামাজের দীর্ঘতা এবং খুতবার সংক্ষিপ্ততা তার সূক্ষ্ম জ্ঞানের পরিচায়ক। সুতরাং তোমরা নামাজকে দীর্ঘ করবে এবং খুতবাকে সংক্ষেপ করবে।’ -সহিহ মুসলিম শরিফ: ১/২৮৬
পনেরো. দুই খুতবার মাঝে ছোট তিন আয়াত পড়া যায়, এ পরিমাণ সময় বসা। -ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি: ১/১৪৬
আল্লামা কাসানি (রহ.) উল্লেখ করেন, জুমার খুতবা দুইটি হওয়া সুন্নত এবং খুতবা মিম্বরে দেয়া সুন্নত। কেননা, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে খুতবা প্রদান করতেন। হযরত জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) দুইটি খুতবা পাঠ করতেন এবং উভয় খুতবার মাঝখানে বসতেন। তিনি কোরআন তেলাওয়াত করতেন এবং লোকদের উপদেশ দিতেন।' -সহিহ মুসলিম শরিফ: ১/২৮৩
যেহেতু খুতবা শোনা ইবাদত এবং জুমার অপরিহার্য অংশ। তাই মুসল্লিদের এ সম্পর্কে জানতে হবে। খুতবার মান বাড়াতে হবে। যে বিষয়ে খুতবা প্রদান করা হবে, সে বিষয়সম্পৃক্ত আয়াত, হাদিস সবিস্তারে তুলে ধরতে হবে।
এ বিষয়ে খতিবদের প্রশিক্ষিত ও খুতবাকে সমৃদ্ধ করে এর দ্বারা উপকৃত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।