বিনোদন, ঢালিউড, টেলিভিশন, সংস্কৃতি

রাজার সিংহাসন ছেড়ে যাওয়ার তিন বছর

কামরুল ইসলাম

ডিবিসি নিউজ

শুক্রবার ২১শে আগস্ট ২০২০ ০৪:০৩:৫১ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

কত নামে, কত উপনামে, কত বিশষণে বিশেষায়িত বাংলা সিনেমার প্রাণপুরুষ নায়ক রাজ রাজ্জাক।সব বাঁধন ছেড়ে আজ থেকে তিন বছর আগে ২০১৭ সালে ২১ আগস্ট না ফেরার দেশে, বসত গড়েছেন সিনেমা ভুবনের মহানায়ক। আজ তার ৩য় মৃত্যু বার্ষিকী। 

রাজ্জাক সাহেবরে এক বাল্যবন্ধু বলে ছিলেন “তিনি নাকি অঙ্কে কাঁচা ছিলেন। তবে সবই খাতার অঙ্কে, বইয়ের অঙ্কে। জীবনের অঙ্কে তিনি এক অন্যন্য সমাধানের নাম। জীবনের জটিল সব চরিত্রের অঙ্কণে তিনি ছিলেন অসাধারণ। এমন কোনো চরিত্র নেই যা তার ভাবনার জোগান হতে পারত। সকল চরিত্রে তিনি ছিলেন সাবলীল। দীর্ঘ পঞ্চাশের বছরের চলচ্চিত্রে অভিনয় জীবন তার। পঞ্চাশ বছরের জীবন কি এক শোক বার্তায় তুলে আনা সম্ভব? সহজ সরল উত্তর। কোনো প্যাঁচগোঁচ নেই। আর যাই হোক রাজ্জাক স্যারের ক্যারিয়ার নিয়ে বাহাসে কত শত পৃষ্ঠা আর দিনের প্রয়োজন তা বলার দরকার কি? 

তার পুরো নাম ছিল আব্দুর রাজ্জাক। চলচ্ছিত্রে তিনি শুধু রাজ্জাক বলেই আবির্ভূত হন। চলচ্চিত্রের পথচলায় একের পর এক সাফল্যকে মুঠোবন্দি করতে করতে একসময় তিনি হয়ে ওঠেন অনন্য এক মানুষ। তার অভিনয়ের ঔজ্জ্বল্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি। অভাবনীয় সাফল্যের গুণে তিনি ভূষিত হন ‘নায়করাজ’ উপাধিতে। আর এ উপাধি তাকে দিয়েছিলেন প্রয়াত খ্যাতিমান সাংবাদিক চিত্রালি সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী। 

রাজ্জাক ১৯৪২ সালের ২৩শে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আকবর হোসেন ও মাতার নাম নিসারুননেছা। রাজ্জাকরা ছিলেন নাকতলা এলাকার জমিদার। তিনি কলকাতার বাশদ্রোণীর নিকটে খানপুর হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন। অভিনয়ের জন্যই তিনি জন্মে ছিলেন তাই বলেই হয়তো তার শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে মঞ্চনাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য বেছে নেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা মঞ্চ নাটকে বিদ্রোহীতে গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়ক রাজের অভিনয়ে পথচলা শুরু। অভিনয়কে ভালবেসে ১৮ বছর বয়সে পালিয়ে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান রাজ্জাক। কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি। ফিরে আসেন বাড়িতে।

কলকাতায় মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে টুকটাক কাজ করতে থাকেন। নাট্যকার পীযূষ বসু কিশোর রাজ্জাককে উৎসাহ দেন নানাভাবে। যদিও খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। ঢাকায় ইতিমধ্যেই চলচ্চিত্রশিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেকেই রাজ্জাককে উপদেশ দিলেন ঢাকায় আসার জন্য। পীযূষ বসু রাজ্জাক সম্পর্কে একটি প্রশংসাপত্র লিখে দেন। রাজ্জাক ওই প্রশংসাপত্র নিয়ে জন্মস্থান কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৬৪ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে এক রাতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এক হিন্দু পরিবারের বাড়িতে আশ্রয় নেন। পরের দিন ২৬ এপ্রিল পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। তার সাথে ছিল তার স্ত্রী লক্ষ্মী ও পুত্র বাপ্পারাজ এবং পীযূষ বসুর দেয়া সেই চিঠি ও পরিচালক আব্দুল জব্বার খান ও শব্দগ্রাহক মণি বোসের ঠিকানা। স্ত্রী পুত্রকে শরণার্থী শিবিরে রেখে তিনি আব্দুল জব্বার খানের সাথে সাক্ষাৎ করলে জব্বার খান তাকে আশ্বাস্ত করেন। 

পরিচালক আবদুল জব্বার খান তাঁকে কাজের সুযোগ করে দেন ‘ইকবাল ফিল্মস’ প্রতিষ্ঠানে। এ প্রতিষ্ঠানের ছবি ‘উজালা’য় পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। সহকারী হিসেবে দ্বিতীয় ছবি ছিল ‘পরওয়ানা’। কিন্তু, ছবির কাজ শতকরা ৮০ ভাগ হওয়ার পরই সহকারীর কাজ ছেড়ে দেন। কারণ, রাজ্জাক নায়ক হতে এসেছিলেন। ক্যামেরার সামনেই দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। পর্দায় নাম ভেসে ওঠার শুরুতেই নিজের নাম খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন।

প্রথমদিকে রাজ্জাক তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে "ঘরোয়া" নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা পান। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের ১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন এবং কার বউ, ডাক বাবু, আখেরী স্টেশনসহ আরও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন।

কিন্তু, কেউ তার জাত চিনতে পারেনি। চিনেছিলেন বাংলা সিনেমার কালজয়ী পরিচালক জহির রায়হান। ১৯৬৬ সালে তার বেহুলা সিনমোর জন্য রাজ্জাককে বেছে নেন জহির রায়হান।

ভাগ্য বড্ড বিশ্বাসী রাজ্জাক এক সাক্ষাৎকারে প্রথম নায়ক হওয়ার বিষয়ে বলেছিলেন 'ভাগ্যচক্রে হঠাৎ একদিন নায়ক হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। সে এক কাহিনী। লোককাহিনী নিয়ে জহির রায়হান 'বেহুলা' ছবি নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 'বেহুলা' হবেন সুচন্দা। কিন্তু লখিন্দরের চরিত্রে কাউকেই তার পছন্দ হচ্ছে না। ওই সময়ে যারা একটু নামি-দামি শিল্পী, তারা প্রায় পুরো ছবিতেই কঙ্কাল হয়ে শুয়ে থাকতে চাইলেন না। এমন সময় হঠাৎ একদিন জহির রায়হান বললেন, 'রাজ্জাক, আপনিই আমার ছবির নায়ক।' হয়ে গেলাম 'বেহুলা' ছবির নায়ক। সুযোগের সদ্ব্যবহারও করলাম। জহির রায়হানের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় অসাধারণ লখিন্দর হয়ে দর্শকের সামনে উপস্থিত হয়েছিলাম আমি। সঙ্গে অপূর্ব সুন্দরী বেহুলারূপী সুচন্দা। ১৯৬৬ সালে মুক্তি পেল 'বেহুলা'। ছবিটি সুপারহিট ব্যবসা করল।'

 

আর ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্জাককে। বেহুলার পরের যা হয়েছে সবই ইতিহাস। একে একে গড়েছেন রেকর্ড। আবার নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙেছেন। জুটি গড়েছে। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে মোট ১৮ জন নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করেছেন তিনি। সবচেয়ে বেশি অভিনয় করেছেন নায়িকা শাবানার বিপরীতে ৪০টি ছবিতে। এ তালিকায় দ্বিতীয় হচ্ছেন ববিতা। তার সঙ্গে অভিনীত ছবির সংখ্যা ৩৯টি। রাজ্জাক ১৯৯০ সাল পর্যন্ত নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। নায়ক হিসেবে তার অভিনীত শেষ ছবি ‘মালামতি’। এতে নায়িকা ছিলেন নূতন। নায়ক চরিত্রের বাইরে তিনি অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন ১৯৯৫ সাল থেকে।

নায়িকা কবরীর সঙ্গে তৈরি হয়েছিল নায়করাজের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আবির্ভাব’ ছবিতে রাজ্জাক-কবরী জুটিকে দর্শক পর্দায় প্রথম দেখেন। এ দু’জন জুটি হয়ে বেশ কয়েকটি ছবিতে কাজ করেছেন। প্রযোজকদের কাছে এ জুটির ব্যাপক চাহিদা ছিলো। 

 

পরিচালক হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল। ১৯৮৯ সালে রাজ্জাক জ্বীনের বাদশা চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এই ছবিতে অভিনয় করেন তার বড় পুত্র বাপ্পারাজ। ছবিটি একটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এই দশকে তার পরিচালিত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো হল প্রফেসর (১৯৯২), বাবা কেন চাকর (১৯৯৭), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৯৭)।

বাবা কেন চাকর ছবিতে রাজ্জাক বাবার চরিত্রে অভিনয় করেন। তার দুই সন্তান চরিত্রে অভিনয় করেন আবুল কাশেম মিঠুন এবং বাপ্পারাজ। তার সর্বশেষ পরিচালিত চলচ্চিত্র ২০১৪ সালে ‘আয়না কাহিনি’। তার অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ২০১৪ সালে ‘কার্তুজ’।

চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা হলেও টেলিভিশনের প্রতি নায়করাজ রাজ্জাকের ছিল ব্যাপক আগ্রহ। ক্যারিয়ারের শুরুতে ‘ঘরোয়া’ নামের একটি টিভি নাটকে অভিনয় করে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। মৃত্যুর আগের কয়েক বছর চলচ্চিত্রের কাজ কমিয়ে দিয়ে এ অভিনেতা নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন টিভি নাটক কিংবা টেলিফিল্মের সঙ্গে। বিশেষ করে ছেলে সম্রাটের নির্মাণে বেশ কয়েকটি টিভি নাটকে কাজ করেন তিনি। আর মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন।

রাজ্জাক ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট সন্ধ্যা ৬:১৩ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপতালে মৃত্যুবরণ করেন কালজয়ী এ অভিনেতা। ২৩ আগস্ট তাকে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তোমাকে 
ভালো থেকো তুমি ওপাড়ে 
কোটি কোটি ভক্ত অনুকূল 
দোয়া মাফে তোমার লাগি
রেখে যাওয়া কর্মলীলা রইল 
স্মৃতি হয়ে আমাদের তরে...

আরও পড়ুন