বাংলাদেশ, রাজধানী

দিনে-রাতে মশার উৎপাতে অতিষ্ট রাজধানীবাসী

ফারুক

ডিবিসি নিউজ

বুধবার ৩০শে মার্চ ২০২২ ০২:৩৪:৫১ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

শীতের শেষে রাজধানীতে বেড়েছে মশার উপদ্রব। দিনে রাতে মশার উৎপাতে অতিষ্ট নগরবাসী। রেহাই পেতে বিভিন্ন উপায় বেছে নিতে হচ্ছে নগরবাসীকে। মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের দেয়া ওষুধ নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। আর সিটি করপোরেশন বলছে, সবার সহযোগিতাই মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।

দিনের বেলায় এভাবে মশারি টানিয়ে ঘুমানোর দৃশ্য রাজধানীবাসীর জন্য নতুন কিছু নয়।  তবে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ট নগরবাসী।

ভুক্তভোগীরা বলেন, দিনে-রাতে সবসময়ই মশারী নয়তো মশার কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। 

শুধু মশারি টানিয়ে নয়, কয়েল ধরিয়েও মশা অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছেন না ভূক্তভোগীরা।  একদিকে গরম অন্যদিকে মশার অত্যাচারে টিকে থাকা দায়।  গল্পটা মিরপুরের রুপনগরের; যা ঢাকা উত্তর সিটির ৭ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে।

অনেকে অভিযোগ করেন, সিটি করপোরেশন মশক নিধনে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। 

ঘরে-বাইরে, দোকানে সব জায়গাতেই দিনের বেলাতেই কয়েল জ্বালিয়ে মশা তাড়ানোর চেষ্টা চলে।

অনেকে আবার মশার ওষুধের গুণাগুণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। 

রাজধানীর খাল ও নালাগুলো এখনো মশার বসতিমুক্ত না করাকেই এ ভোগান্তির মূল কারণ হিসেবে দেখছেন সাধারণ মানুষ।  অভিজাত এলাকায় মশা নিধন কার্যক্রমের দেখা পেলেও বস্তিবাসীর জন্য তা যেন স্বপ্ন।  আর মশার ওষুধ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতাকে দায়ী করে কেউ কেউ। 

মশার কামড়ে যখন দিশেহারা সাধারণ মানুষ।  তখন মশা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দাবি করছেন সিটি করপোরেশনের কর্তারা।

ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জোবায়দুর রহমান বলেন, মশক নিধনে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। খুব শিগগিরই সমস্যার সমাধান হবে। 

মশার বংশবিস্তার রোধ না করা গেলে দুর্ভোগের পাশাপাশি সামনের দিনগুলোতে হুমকির মুখে পড়বে জনস্বাস্থ্যও।

সন্ধ্যা নামলেই নগরজুড়ে কায়েম হয় মশার রাজত্ব। তবে মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছে না নগরবাসী। নগর কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর কথা বললেও ওষুধে কাজ হয় না। ওষুধের মান নিয়ে সন্দিহান হাজারীবাগের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিজেই। আর তাই ঢাকার দুই মেয়রের কাছে জরুরিভাবে মশার উপদ্রব কমাতে উদ্যোগ নেয়ার দাবি তাদের।

উত্তর সিটির দাবি, মশা নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী কর্মসূচি থাকে তাদের। নেয়া হয় ক্র্যাশ প্রোগ্রামও। তবে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কেবল মেয়র আর গণমাধ্যম দেখলেই ছিটানো হয় ওষুধ। বাকি সময় কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না।

রাজধানীর খিলক্ষেতের উত্তর নামাপাড়ার বাসিন্দা শাহীন খান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। স্থানীয় দোকান থেকে কিনছিলেন মশার কয়েল। এ সময় উপস্থিত অন্যদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন তিনি। আলোচনার প্রধান বিষয় ‘মশার যন্ত্রণা’। সবার কথায় একটা বিষয় উঠে আসে- রাজধানীতে হঠাৎই বেড়েছে মশার উপদ্রব; কোনোভাবেই এ থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না।

শাহীন খান বলেন, ‘শীত শেষে রাজধানীতে মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। কোনোভাবেই মশা কমছে না। দিনে কিছুটা কম থাকলেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় মশার জ্বালাতন, চলে সারারাত। সিটি করপোরেশনের নানা উদ্যোগের কথা শুনি। এই তো গত ১০ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপাী মশা নিধনে উত্তর সিটি করপোরেশনের বিশেষ কার্যক্রমের কথা টেলিভিশনে দেখলেও খিলক্ষেতে এই কার্যক্রম দেখিনি। আর তাই বাধ্য হয়েই মশা নিধনে তাদের দেয়া ‘আশ্বাসই’ এখন আমাদের ভরসা।’

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, মার্চ মাসে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে মশার ঘনত্ব আরো চার গুণ বাড়বে। ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বছরের এ সময়ে মশার জীবনচক্রের গতিশীলতা বেড়ে যায়। এ সময়ে মশা ডিম বেশি পাড়ে। গত বছরের জুন-জুলাইয়ের তুলনায় এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে এসে মশার ঘনত্ব প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে খালের পানিতে আর খিলক্ষেত এলাকার বনরূপা প্রকল্পের দক্ষিণ পাশে (কাপালি) থাকা জলাশয়গুলোতে দিনের আলোয় মশার সমাবেশই বলে দেয়, তাদের দাপটে কতটা কোণঠাসা এলাবাবাসী। খোলা জায়গা থেকে বাসা-অফিস সবখানেই মশার অবাধ বিচরণ। সবচেয়ে বিপদে শিশু আর বয়স্করা। খিলক্ষেত কাপালী এলাকার বাসিন্দা শাকিব হোসেন বলেন, স্থির হয়ে কোথাও বসা বা কিছুই করা যায় না। মশা কামড়াতেই থাকে। আগের চেয়ে মশার উৎপাত কয়েক গুণ বেড়েছে। মশা বেড়ে যাওয়ায় কয়েলের দামও বেড়েছে। আগে চায়না কয়েল ছিল ৭০ টাকা প্যাকেট, সেটি এখন ৮০ টাকা। যদিও কয়েলে খুব একটা কাজ হয় না।

বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সব এলাকার চিত্র একই রকম। সড়ক থেকে ঘর, স্টেশন থেকে গণপরিবহন সর্বত্রই মশার উপদ্রব। মশার গুনগুন শব্দের সঙ্গে হুল ফোটানো নিত্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে সড়কে যানজট। সবকিছু মিলে রাজধানীবাসীর জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বাংলামোটর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মো. সাঈদ খান বলেন, রাস্তায় নামলে যানজট আবার ঘরে ফিরলে মশার উপদ্রবে জীবনটা যেন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। তবুও কর্মের তাগিদে থাকতেই হচ্ছে এই নগরীতে। তিনি বলেন, ‘রাজধানী এখন মশার দখলে। মশা থেকে বাঁচতে বাজার থেকে স্প্রে, কয়েল, অ্যারোসল নিয়েছি। তবে কোনো কিছুতেই মশা তাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।’ মশার উপদ্রব নিয়ে মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা নিলুফা আক্তার বলেন, ঘরে ছোট বাচ্চা আছে, যে কারণে কয়েল-অ্যারোসল কিছুই দেয়া যায় না। সারাদিন মশারি টাঙিয়ে বাচ্চাকে রাখতে হয়। ঘরের কোথাও স্থিরভাবে বসা যায় না।

মশার কামড়ে হাত-পা লাল হয়ে যায়। একই অভিযোগ জানিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশনের যারা মশার ওষুধ ছিটায়, তাদের কখনো দেখি না। তারা কখন এসে মশার ওষুধ ছিটায়? এদিকে, মশারি টানিয়ে, স্প্রে করে কিংবা কয়েল জ্বালিয়েও নিস্তার পাচ্ছেন না হাজারীবাগের বাসিন্দারা। সন্ধ্যা নামতেই রক্ত খেয়ে টইটুম্বুর মশার পেট। এই এলাকার কেউ আবার ধুপের ধোঁয়া দিয়ে মশা তাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এলাকাবাসী বলছেন, আঁধার নামতেই মশার কাছে আত্মসমর্পণ যেন নিয়তিতে পরিণত হয়েছে।

হাজারীবাগের বাসিন্দা ডা. নূরুল আলম বলেন, এখানে প্রচুর মশা। মশায় কামড় দিলে খালি চুলকাতে থাকে। ওষুধ দিয়ে যায়, কিন্তু মশা তেমন একটা মরে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমান বাবুল বলেন, মশা সম্ভবত এন্টিবায়োটিক খায়! তাই ওষুধ দিলেও এখন আর মশা মরে না। যারা এটা নিয়ে গবেষণা করেন তাদের নতুন করে চিন্তা করতে হবে, ওষুধ ছিটালেও কেন মশা মারা যায় না? ওষুধের পরিবর্তন করতে হবে নাকি ওষুধের ডোজ বাড়াতে হবে?

সাধারণ নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নগরবাসী। দুই সিটি করপোরেশনের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। নগরবাসীর পক্ষ থেকে ঢাকার দুই মেয়রের কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনারা মশার উপদ্রব কমাতে জরুরিভাবে উদ্যোগ নিন।

গত ৩ মার্চ ডেঙ্গু ও মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন, বিভাগ, দফতর, সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সভাপতিত্ব করেন। সভায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম নাগরিকদের সচেতনতার কথা বলেন। মশামুক্ত নগর গড়তে বদ্ধপরিকর বলেও জানান তিনি। সভায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, এডিস মশাসহ অন্যান্য মশা নিধনে চলতি বছরের জন্য পর্যাপ্ত কীটনাশক মজুত রয়েছে।

মশক নিধন বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, কিউলেক্স মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে। এখানে কারো বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) কিউলেক্স মশার মোট ৯২৫টি হটস্পট শনাক্ত করা হয়। এসবের মধ্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সাতারকুল। এরপর রয়েছে মিরপুর। ডিএনসিসির ১০টি অঞ্চলে মশা নির্মূলে নিয়মিত কর্মীর সংখ্যা ৫৫০। পাশাপাশি আরো কিছু অনিয়মিত কর্মীসহ সর্বমোট মশককর্মী হিসেবে কাজ করছেন প্রায় এক হাজার কর্মী।

অন্যদিকে, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে গতিশীল করার লক্ষ্যে গত বছর বেশকিছু নতুন যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কিনেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তাদের দাবি, তারা ৭৫টি ওয়ার্ডেই নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে প্রতি ওয়ার্ডে ১৪ জন করে ৭৫টি ওয়ার্ডে মোট এক হাজার ৫০ জন কর্মী লার্ভিসাইডিং, এডাল্টিসাইডিং এবং সমন্বয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। মশক নিধনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমাদের কাজ চলমান রেখেছি। তবে এই সময়ে এসে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। তাই আমরাও আমাদের কার্যক্রম আরো গতিশীল করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

জানা গেছে, সর্বশেষ অর্থবছরে মশক নিধনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রায় আট কোটি টাকা কমিয়ে ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে। যেখানে তার আগের অর্থবছরে ৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সর্বশেষ অর্থবছরের বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ৫৮ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন