জেলার মর্গগুলো ময়নাতদন্তের জন্য উপযোগী নয়।
দেশের বেশিরভাগ মর্গই জেলার সদর হাসপাতালগুলো থেকে বেশ দূরে। ফলে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের বাইরে যেতে হয় চিকিৎসকদের। এছাড়া অপরিকল্পিতভাবে তৈরি প্রায় সবগুলো মর্গেই নেই ভেন্টিলেশন, পর্যাপ্ত আলো পানি এবং নিষ্কাশন ব্যবস্থা। মর্গ নিয়ে হিমেল মাহবুবের ধারবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বে ঢাকার বাইরের মর্গগুলোর অবস্থা।
লালমনিরহাটের একমাত্র মর্গটি সদর হাসপাতাল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে মৎস অফিসের পাশে আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। এটিকে ইদুর আর উইপোকার বাসা বললে ভুল হবেনা। প্রায় চল্লিশ বছরপূর্বে নির্মিত মর্গটি সংস্কারের অভাবে ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় রয়েছে। নেই বিদ্যুৎ সংযোগ ও আধুনিক যন্ত্রপাতি। মরদেহ ধোয়া পানি ফেলা হয় পুকুরে।পাশপাশি সেখানে চলছে মাছ চাষ।তাছাড়া প্রধান সড়ক থেকে মর্গে লাশ নেয়ার জন্য কোন রাস্তা করা হয়নি।মরদেহ ধোয়া পানি পড়ছে পাশের পুকুরে। এলাকাবাসীদের অভিযোগ, মরদেহ ধোয়া পানি পুকুরে ফেলা হয় এবং সেই পুকুরে চাষ করা হয়। এ পুকুরের মাছ খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। আর বেওয়ারিশ লাশ যেগুলো একেবারে পচে যায় সে লাশ গুলোকে মর্গের উঠানে ফেলে কাটাকাটি করা হয়।তারা মর্গটি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবি জানান।
কুড়িগ্রামে সদর হাসপাতাল থেকে মর্গটি তিন কিলোমিটার দূরে। ৫ বছর আগে মর্গের বিদ্যুৎ ও পানির লাইন চুরি হয়, এরপর আর সংস্কার হয়নি। মোম দিয়ে চলছে ময়নাতদন্তের কাজ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালের মর্গ হাউজ বা লাশ কাটা ঘরের কার্যক্রম জরাজীর্ন অবস্থায় চলছে। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। লাশ কাটা ঘরে পানির ব্যবস্থা না থাকা, রক্ত নিস্কাসনের নেই কোন ব্যবস্থা বা পরিস্কার পরিছন্ন না থাকায় দুর্গন্ধ ছাড়াচ্ছে। জরুরী বিভাগের পাশে পুরনো ঘরে চলছে ময়না তদন্তের কাজ। ফলে হাসপাতালে আসা রোগী কিংবা স্বজনদের অভিযোগও অনেক।
জামালপুরেও জেনারেল হাসপাতাল থেকে মর্গের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। শহরের বনপাড়া এলাকায় ফৌতি গোরস্থানে তিন যুগের বেশি সময় আগে তৈরি ভবনটি বলতে গেলে পরিত্যাক্তই। এরই মধ্যে চলছে ময়নাতদন্তের কাজ। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় মৃতদেহের রক্ত ও দূষিত বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে যে লাশ কাটা ঘর আছে সেখানে কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। ২০১২ সালে গোপালগঞ্জ শহর শ্মশান থেকে লাশ কাটা ঘরটি এই হসপিটালের ভেতরে মেডিসিন ওয়ার্ডের পাশে স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে এর সামনে গড়ে ওঠে নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। স্বাভাবিক ভাবেই মর্গের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে অবর্জনা, শাশের চুল। অপর দিকে মর্গ ভবনের ভেতরে গিয়ে দেখা যায় মাত্র ৭ বছর আগে নির্মত ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। নিম্নমানের নির্মাণ কাজের জন্য বিভিন্ন কক্ষের পলেস্তারা খসে পড়ছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র যেগুলো লাগানো হয়েছে সেগুলো যেকোনো সময় নিচে খুলে পড়ে দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।
শরীয়তপুরের মর্গটি ১৯৯৫ সালে সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের পাশেই নির্মাণ করা হয়। দুর্বল অবকাঠামো হওয়ায় ছাদ দিয়ে পড়ছে পানি, খসে পড়ছে দেয়ালের প্লাষ্টার, গাছের শিকড় জমেছে পুরো কক্ষেই, নেই বৈদ্যুতিক সংযোগ । লাশ কাটা পানি নিস্কাশনের নেই কোন ব্যবস্থা। খোলা পাইপের মাধ্যমে মর্গের পেছনেই জমেছে পানি আর দুষিত হচ্ছে পরিবেশ। এ ছাড়াও মর্গের পাশেই হাসপাতালের মূল ফটক। ফটকের সামনেই হাসপাতালের ময়লা ফেলার ডাস্টবিন। নতুন করে লেবারদের জন্য তৈরী করা হয়েছে ২টি খোলা বাথরুম। সব মিলিয়ে ৪ এর সমন্বয়ে হাসপাতালে ঢুকতেই দুর্গন্ধ পোহাতে হচ্ছে রোগীসহ রোগীদের স্বজনদের।
প্রায় পঁচিশ বছর পার হলেও নড়াইল সদর হাসপাতালের মর্গ নানা সমস্যায় জর্জরিত। প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় চলছে মৃতদেহ ময়না তদন্তের কাজ। মর্গরুমে সবকিছুর উপরেই ধুলার আস্তরন পড়ে আছে। দেয়াল ও ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। নাটোর জরাজীর্ণ মর্গের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে চলছে মরদেহের ব্যবচ্ছেদ।
ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় মেড্ডা এলাকায় সদর হাসপাতালের নিজস্ব একটি স্থাপণা রয়েছে। তবে সেই মর্গটি দখল করে রেখেছে স্থাণীয় প্রভাবশালীরা । ফলে হাসপাতালের মরদেহ সংরক্ষণ কক্ষটিকেই দুই দশক ধরে মর্গ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এদিকে লাশঘরটিতে নেই কোনো ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা। মরদেহ ধোয়ার পর রক্ত ও পানি ছাড়া হয় লাশঘরের সামনের সরু ড্রেন দিয়ে। লাশঘরটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পাশে হওয়ায় দুর্গন্ধের কারণে দুর্ভোগে পড়েন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীও স্বজনরা দুর্ভোগের কথা জনান।
চাঁদপুরে শুকরের খামারের পাশে জরাজীর্ণ ভূতুড়ে ভবনটিতেই চলছে ময়নাতদন্তের কাজ। জেনারেল হাসপাতাল থেকে মর্গটি দুই কিলোমিটার দূরে স্বর্ণখোলা রোডে অবস্থিত। দূরত্ব আর নানা সংকটে ময়নাতদন্তের কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। এতে করে দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে চিকিৎসকসহ ভূক্তভোগীর আত্মীয়দের। চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের মর্গে কাজ করা বাপ্পী ডোম জানান, চিকিৎসক আসতে যেতেই অনেক সময় লাগে। ভবনটি পরিত্যক্ত প্রায়। মর্গের সামনে ময়লার ভাগাড় থাকায় অনেককেই তা পাড়িয়ে মর্গে ঢুকতে হয়।
ফেনীতে লাশকাটা ঘরের সামনে হাসপাতালের গেইট, একপাশেই সড়ক, অপরপাশে খাবার হোটেল-হওয়ায় দুর্গন্ধে হাসপাতালে আসা রোগীসহ জনগণকে চরম ভোগান্তীতে পড়তে হয়। মর্গে নেই কোনো জেনারেটর। ময়নাতদন্তের সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় মেঝেতে রেখে চলে লাশ ময়নাতদন্তের কাজ।
সুনামগঞ্জেও একই অবস্থা, মর্গের পাশেই ময়লার ভাগাড়।ডিবিসি নিউজের ক্যামেরা দেখেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফোন দেন সিভিল সার্জন। নতুন ভবনের দাবি জানান তিনি।
দেশের বেশির ভাগ মর্গগুলোর একই চিত্র। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সেলিম রেজা জানান, “দেশের মর্গগুলো পরিকল্পিত ভাবে নির্মিত হয়নি। ফলে মর্গগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত। ভেন্টিলেশন আর ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় চরম সমস্যায় পড়তে হয় চিকিৎসক, ডোম এবং এখানে আসা মানুষদের। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে গেলে পরিকল্পিতভাবে মর্গ নির্মাণ, ফরেনসিক চিকিৎসক বাড়ানো, ডোম নিয়োগ এবং যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন প্রয়োজন”।