দক্ষিণ সিরিয়ার সুওয়াইদা প্রদেশে নতুন করে মারাত্মক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, যা দেশটির ভঙ্গুর নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও একবার সামনে এনেছে। দ্রুজ সংখ্যালঘু এবং সুন্নি বেদুইন যোদ্ধাদের মধ্যে এই সংঘর্ষের মধ্যেই ইসরায়েল সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
গত রবিবার, ১৩ই জুলাই, একজন দ্রুজ বণিকের অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দ্রুজ মিলিশিয়া এবং স্থানীয় সুন্নি বেদুইন যোদ্ধাদের মধ্যে কয়েক দিনব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ইসরায়েল সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করে।
ইসরায়েলি বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা দ্রুজদের রক্ষা করতে এবং তাদের উপর হামলাকারী সরকারপন্থী বাহিনীকে নির্মূল করতে এই অভিযান চালাচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (SOHR) জানিয়েছে, রবিবার থেকে সুওয়াইদা প্রদেশে শুরু হওয়া এই সহিংসতায় অন্তত ৩০০ জন নিহত হয়েছেন।
এই ঘটনাটি দ্রুজ-সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশটিতে গত এপ্রিল ও মে মাসের পর প্রথম বড় ধরনের সহিংসতা। এর আগে মার্চের সংঘর্ষে সাবেক শাসক বাশার আল-আসাদের আলাউয়ি সম্প্রদায়ের শত শত সদস্য নিহত হয়েছিলেন বলে জানা যায়।
এই মারাত্মক অস্থিরতা এবং ইসরায়েলি হামলা সিরিয়ায় নিরাপত্তা ভেঙে পড়ার আশঙ্কাকে নতুন করে উস্কে দিয়েছে।
দেশটি এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের পরিণতি এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ইসলামপন্থীদের নেতৃত্বে দামেস্ক দখলের পরের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। সিরিয়ার বর্তমান নেতা, সাবেক জিহাদি আহমেদ আল-শারাহ, দেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
দ্রুজ কারা?
দ্রুজরা সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল এবং অধিকৃত গোলান মালভূমিতে বসবাসকারী একটি আরবিভাষী নৃতাত্ত্বিক-ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তাদের ধর্ম শিয়া ইসলামের একটি শাখা হলেও এর নিজস্ব স্বতন্ত্র পরিচয় ও বিশ্বাস রয়েছে।
সারা বিশ্বে দ্রুজদের সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ, যার অর্ধেকই সিরিয়ায় বাস করে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩%।
অন্যদিকে, ইসরায়েলে বসবাসকারী দ্রুজ সম্প্রদায় সে দেশের প্রতি অনুগত বলে পরিচিত এবং তাদের সদস্যরা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে কাজ করে। ইসরায়েলের সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ স্ট্যাটিস্টিকস অনুসারে, ইসরায়েল ও অধিকৃত গোলান মালভূমিতে প্রায় ১,৫২,০০০ দ্রুজ বাস করেন।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় দ্রুজরা দেশের দক্ষিণে নিজেদের মিলিশিয়া বাহিনী পরিচালনা করত। আসাদের পতনের পর থেকে তারা নতুন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে অস্বীকার করে আসছে। যদিও নতুন সরকারের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন (কেউ সতর্ক, কেউ সরাসরি বিরোধী), অনেকেই সুওয়াইদা প্রদেশে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি এবং সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিরোধিতা করে স্থানীয় মিলিশিয়াদের উপর নির্ভর করে আছে।
কেন ইসরায়েল সিরিয়ায় হামলা চালাচ্ছে?
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার মূল উদ্দেশ্য হলো সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে দক্ষিণ সিরিয়ায় প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখা এবং ওই অঞ্চলে একটি অসামরিকীকৃত অঞ্চল (demilitarised zone) তৈরি করা। বিশেষ করে, ইসরায়েল তার উত্তর সীমান্তে, অধিকৃত গোলান মালভূমির কাছে, ইসলামপন্থী যোদ্ধাদের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
যদিও ১৫ই জুলাইয়ের বিমান হামলা সুওয়াইদা প্রদেশের নিরাপত্তা বাহিনী এবং যানবাহনকে লক্ষ্য করে সীমাবদ্ধ ছিল, ১৬ই জুলাই ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাদের আক্রমণের পরিধি বাড়িয়ে দেয়। এদিন দামেস্কে অবস্থিত সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সেনাবাহিনীর সদর দফতরে হামলা চালানো হয়।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরের পর এটিই ছিল সিরিয়ায় সবচেয়ে গুরুতর ইসরায়েলি হামলা। ডিসেম্বরে আসাদ সরকারের পতনের পর ইসরায়েল দেশজুড়ে শত শত সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করে এবং গোলান মালভূমিতে জাতিসংঘের টহলাধীন একটি বাফার জোন দখল করে নেয়।
ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ ১৬ই জুলাই দামেস্কে হামলার কিছুক্ষণ পরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, "দামেস্কে সতর্কবার্তা শেষ - এখন বেদনাদায়ক আঘাত আসবে।"
সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলার ঘটনাটি সিরিয়ার একটি প্রধান টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করে, যার স্টুডিওটি ওই ভবনের ঠিক উল্টো দিকে অবস্থিত ছিল। সম্প্রচার চলাকালীন উপস্থাপককে স্টুডিও থেকে পালিয়ে যেতে দেখা যায়।
কিছু দ্রুজ নেতা অবশ্য অভিযোগ করেছেন যে, ইসরায়েল এই অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য সাম্প্রদায়িক বিভেদকে উস্কে দিচ্ছে।
তথ্যসূত্র বিবিসি।
ডিবিসি/এমইউএ