নেত্রকোনার কলমাকান্দায় সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে গোমাই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে আরিফ এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যার ফলে সিধলী সেতুসহ আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। ইজারার শর্ত লঙ্ঘন করে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেতুর নিকট থেকে বাংলা ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করায় সিধলী বাজার, সড়ক, ফসলি জমি ও বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
গোমাই নদীর উপর সিধলী সেতুটি। এছাড়া সিধলী বাজার, সিধলী-কলমাকান্দা সড়ক, গুচ্ছ গ্রাম, বেরীবাঁধসহ আশেপাশের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন গ্রামবাসী।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রাজস্ব শাখা সূত্রে জানা গেছে, এর আগে নেত্রকোনায় প্রশাসন কর্তৃক অনুমোদিত ছিল ৭টি বালু মহাল। এর মধ্যে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় ৬টি বালু মহালের ইজারা কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। শুধু সদর উপজেলার বোবাহালা মৌজায় ১৪ একর ৫৮ শতাংশ জায়গা জুড়ে গোমাই নদীতে বালু মহাল ইজারা রয়েছে।
আরিফ এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকায় এই বালুমহালটি ইজারা নেয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, ইজারাদার আরিফ খান কোন রকম নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে ইজারা বর্হিভুত কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটি ইউনিয়নের সিধলী সেতু এলাকা থেকে ড্রেজার দিয়ে দেদারচে বালু উত্তোলন করছেন। স্থানীয় লোকজন বাধা দিলেও কাজ হচ্ছে না। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
যদিও বালু মহাল ইজারা নীতিমালায় সেতু, বক্স কালভার্ট, সড়ক, রেললাইন, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, হাট বাজারের এক কিলোমিটার এলাকা থেকে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ রয়েছে। এছাড়া পরিবেশ বিধ্বংসী বাংলা ট্রেজার দিয়েও বালু উত্তোলন করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে সিধলী বাজার, সড়ক ও সেতু থেকে প্রায় ৫০ মিটার দূরে ড্রেজার দিয়ে বড় নৌকায় বালু উত্তোলন করে তীরে টাল দেয়া হচ্ছে।
আর ইজারদারের স্বার্থে এই অবৈধকাজে কৈলাটি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা রুবেল ভূঁইয়া নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। রুবেল ভুঁইয়া প্রভাবশালী হওয়ায় তার ভয়ে ক্যমেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি কেউ। তবে ক্ষোভ প্রকাশ করে নাম গোপন রাখার শর্তে অনেকেই বলেছেন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৫ আগস্ট থেকেই রুবেল ভূঁইয়া বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দলের প্রভাব খাটিয়ে তিনি বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। এছাড়া তার মদদে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে সেতু, বাজার, রাস্তা ছাড়াও ফসলী জমি ও বাড়ি ঘর নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রশাসনও এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
তবে রুবেল ভূঁইয়া এ ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করলেও ইজারাদার আরিফ খানের দাবি, রুবেল ভুঁইয়া তার ব্যবসায়িক অংশিদার এবং তারা নিয়ম মেনেই বালু উত্তোলন করছেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন উপজেলার নদ-নদী থেকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের প্রতিযোগিতা চলছে। এরমধ্যে দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদী ছাড়াও উপজেলার গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর থেকে মুন্সিপাড়া সড়কসংস্কারের জন্য পাশে থাকা মিনকাতলী নদী থেকে দেদারচে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। অবশ্য মাসখানেক আগে সেখানে উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ড্র্রেজার জব্দসহ মামলা করলেও থামছে না। বর্তমানে সেখানে বালু উত্তোলন করছেন গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য সচিব মুন্সীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শুভ আহম্মেদ। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে শুভ আহম্মেদ উপস্থিত থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে পাইপের মাধ্যমে রাস্তায় সরবরাহ করছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সড়ক সংস্কারের কাজটি বালুর জন্য বন্ধ থাকায় এলাকার লোকজনের চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তাই আমি বালু সরবরাহ করছি। এটা অন্যায় কিছু না।
এদিকে, কলমাকান্দার রংছাতি ইউনিয়নের মহাদেও নদের কৃষ্ণপুর, হাসানাগাঁও, বড়োয়াকোনা, ওমরগাঁও, ডায়ারকান্দাসহ বিভিন্ন এলাকায় সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলে।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করে বালু জব্দ ও জরিমানা করলেও প্রভাবশালীদের সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সঙ্গে কোনোভাবেই পেরে উঠছে না।
এভাবে বালু উত্তোলন চলতে থাকলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ। তাদের দাবী, কেবল জেলা ও উপজেলা প্রশাসন নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব পর্যায়ের দায়িত্বরতরা এবং স্থানীয়ভাবে সচেতন মহল ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে না দাঁড়ালে এ সিন্ডিকেট মোকাবিলা করা যাবে না ।
জেলা প্রশাসক বাননী বিশ্বাস বলেন, ইজারাকৃত বালুমহাল থেকে নিয়ম মেনে বালু উত্তোলন করতে হবে অন্যথায় ইজারাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর যেসব নদ-নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়, তা বন্ধে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত আছে।
তবে সচেতন মহল বলছে শুধু আশ্বাস নয় কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে ও যথাযথ আইন প্রয়োগ করলে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ হবে। তাই বালু খেকোদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী তাদের।
ডিবিসি/এইচএপি