নব্বইয়ের দশকে আফগান ফেরত যোদ্ধাদের নিয়ে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু হয়। আর হোলি আর্টিজানে হামলা জঙ্গিদের নাশকতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে আফগান ফেরত যোদ্ধাদের সংগঠন তৈরির মধ্য দিয়ে দেশে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় হামলা চালিয়ে নিজেদের সক্ষমতা জানান দেয় তারা। পাশাপাশি আরো কিছু জঙ্গি সংগঠন জন্ম নেয়। তাদের ধারাবাহিক নাশকতার সবশেষ বড় উদাহরণ গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারী।দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ও বিভিন্ন সময়ে হামলার ঘটনা তুলে ধরা হল।
১৯৮৬ সালে 'মুসলিম মিল্লাত' বাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে দেশে জঙ্গি তৎপরতার সূচনা ঘটে। তৎকালীন চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা মেজর মতিউর রহমান মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে এসে এই বাহিনী গঠন করেন। নিজ গ্রাম কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় ১১৩টি ঘর ও ৬১ টি বাঙ্কার খনন করে শুরু করে যুদ্ধবিদ্যা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।
৮৯ সালের ১২ই ডিসেম্বর মতিউর রহমানের আস্তানায় অভিযান চালায় ৫ শতাধিক পুলিশ। আড়াই দিন ধরে চলা বন্দুকযুদ্ধে পুলিশের দুই সদস্যসহ ২১ জন নিহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মর্টারের গোলাবর্ষণও করা হয়। শেষে ৪৮ জন জঙ্গি সদস্যসহ মতিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। যা দেশে ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রথম বহিঃপ্রকাশ।
হরকাতুল জিহাদ প্রথম বোমা হামলা করে ১৯৯৯ সালে ৬ই মার্চ রাতে যশোরে উদীচী সম্মেলনে। নিহত হয় ১০ জন। আহত হয় ১৫০ জনেরও বেশি। উদীচীর রেশ কাটতে না কাটতেই খুলনার আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় ৮ জন নিহত হয়।
এরপর, ২০০০ সালের ২০ই জুলাই, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বর্তমান ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর জনসভাস্থলের কাছে ও হেলিপ্যাডে বোমা পেতে রাখার ঘটনায় প্রথম হরকাতুল জিহাদ ও মুফতি হান্নানের নাম উঠে আসে।
২০০১ সালের ২০শে জানুয়ারি পল্টনে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা চালালে চারজন নিহত হয়। ওই বছরই রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে হরকাতুল জিহাদ ১০ জনকে হত্যা করে। সেই বছরই গোপালগঞ্জের বানিয়াচং গির্জায় আবারো হামলা চালানো হলে ১০ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি অর্ধশত ব্যক্তি আহত হয়। একই বছরে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে বাগেরহাটে এক জনসভায় রিমোট কন্ট্রোল নিয়ন্ত্রিত শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে ৮ জন নিহত হয়। যার সবগুলো হামলাতেই হুজি সদস্যরা জড়িত ছিলো।
এরপর, ময়মনসিংহে সিনেমা হলে, নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে, টাঙ্গাইলের মাজারে, খুলনায় বাণিজ্যমেলা, হযরত শাহজালালের মাজারসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা করে জঙ্গিরা।
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হবিগঞ্জে গ্রেনেড হামলায় হত্যা করার আগে তারা ব্রিটিশ হাইকমিশনারকেও হত্যার চেষ্টা করে।
হুজির সবচেয়ে বড় ও ভয়ানক হামলা ছিলো ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় অল্পের জন্য বেঁচে যান শেখ হাসিনা।
হুজির এসব হামলার পাশাপাশি জমিয়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি নামে আরেকটি জঙ্গি সংগঠন বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা শুরু করে। ২০০৪ সালে সর্বহারা দমনের নামে নৃশংসতা শুরু করে সংগঠনটি। আট নয় মাসেই ২৪ জনকে হত্যা করে তারা। এরপর, একে একে আদালত চত্বর, সাংস্কৃতিক সংগঠন, যাত্রা ও সার্কাসের প্যান্ডেলে হামলা চালায় তারা।
২০০৫ সালের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিলো ১৭ই আগস্টের সিরিজ বোমা হামলা। এ দিনে জেএমবি ৬৩ জেলায় ৫১১টি স্থানে একযোগে বোমা হামলা চালায়। এতে, তিনজন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়।
এরপর জঙ্গি দমনে সাড়াশি অভিযান শুরু হলে ২০০৬ সালে সিলেটের টিলাগড় এলাকা থেকে জেএমবির আমির শায়খ আবদুর রহমান, ময়মনসিংহ থেকে জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৭ সালে জেএমবির শীর্ষ নেতাদের মৃত্যদণ্ড কার্যকরের পর বেশকিছু দিন জঙ্গিদের কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পাশাপাশি মধ্যপ্রচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের ভাবধারায় নব্য জেএমবির আত্মপ্রকাশ ঘটে। একই সঙ্গে, আল কায়েদার অনুসারী আনসারউল্লা বাংলাটিমও টার্গেট কিলিং শুরু করে।
সবচেয়ে বেশি টার্গেট কিলিং হয় ২০১৫ সালে। তাদের হামলায় নিহত হন অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বাবু, নীলয় নীল, ইতালির নাগরিক তাবেলা সীজার, জাপানী নাগরিক হোসি কুনিও, প্রকাশক আরেফিন দীপনসহ বেশ কয়েকজন লেখক ব্লগার। ঐ বছরই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। যার সবগুলোর দায় স্বীকার করে আইএস।
তবে, এইসব হামলার ঘটনাকে পেছনে ফেলে ২০১৬ সালের ১লা জুলাই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি।
চোরাগোপ্তা, আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার ইতিহাস থাকলেও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের আদলে জিম্মিকরণের মাধ্যমে এটিই ছিল জঙ্গি হামলার প্রথম ঘটনা। এই ঘটনায় ১৭ বিদেশি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হন। আর যৌথবাহিনীর অভিযানে ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
এরপর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একের পর এক অভিযানে কোনঠাসা হয়ে পড়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো। বিভিন্ন অভিযানে নব্য জেএমবির প্রধানসহ শীর্ষ জঙ্গিরা নিহত হয়। আটক করা হয় শীর্ঘ জঙ্গিদের। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট বলছে শেষ জঙ্গিকে পরাস্ত না করা পর্যন্ত অভিযান চলবে।