মানবদেহের সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকা উপাদান হওয়া সত্ত্বেও, পানি প্রায়শই তার প্রাপ্য মনোযোগ পায় না। ২০২৩ সালের সিভিকসায়েন্সের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিনের প্রস্তাবিত পরিমাণ পানির চেয়ে কম পান করেন। এটি একটি গুরুতর সমস্যা, কারণ হাইড্রেটেড থাকা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর উপায়গুলোর মধ্যে একটি।
পানি আমাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, জয়েন্টগুলোর তৈলাক্তকরণ, হজম প্রক্রিয়া, বিষাক্ত পদার্থ অপসারণ, পুষ্টি পরিবহন, শক্তি উৎপাদন, এমনকি হার্ট ও মস্তিষ্কের সঠিক কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথের সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, পর্যাপ্ত হাইড্রেশন দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি, অকাল মৃত্যু এবং প্রকৃত বয়সের চেয়ে দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমাতেও সাহায্য করে।
নিউ ইয়র্ক সিটির ইন্টিগ্রেটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডানা কোহেন বলেন, "শরীরের প্রতিটি কোষের কার্যকারিতার জন্য হাইড্রেশন অপরিহার্য।" তিনি আরও বলেন, "অনেক মানুষই হালকা ডিহাইড্রেশনের শিকার হন এবং তা বুঝতেই পারেন না। এই দীর্ঘস্থায়ী ডিহাইড্রেশন ক্লান্তি, মাথাব্যথা, মনোযোগের অভাব, জয়েন্টে ব্যথা, এমনকি ক্ষুধা হিসেবে ভুল করা যায় এমন আকাঙ্ক্ষার কারণ হতে পারে।"
এই সমস্যাগুলো এড়াতে আপনাকে সাহায্য করার জন্য, নিচে হাইড্রেশন সম্পর্কে কিছু প্রচলিত মিথ এবং তার পেছনের সত্য তুলে ধরা হলো:
১. দৈনিক ৬৪ আউন্স পানি পানের মিথ: অনেকে মনে করেন প্রতিদিন ৬৪ আউন্স (প্রায় ৮ গ্লাস) পানি পান করাই যথেষ্ট। কিন্তু সান দিয়েগোর পুষ্টি ও সুস্থতা বিশেষজ্ঞ ওয়েন্ডি বাজিলিয়ানের মতে, "হাইড্রেশনের প্রয়োজন ব্যক্তিভেদে শরীর, কার্যকলাপ এবং পরিবেশের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।" ন্যাশনাল একাডেমী অফ সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিনের ইনস্টিটিউট অফ মেডিসিনের নির্দেশিকা অনুযায়ী, নারীদের প্রতিদিন ১১.৫ কাপ এবং পুরুষদের ১৫.৫ কাপ পানি পান করা উচিত। গ্রীষ্মকালে বা ব্যায়ামের সময় আপনার আরও বেশি পানি প্রয়োজন হতে পারে, এমনকি যখন আপনি দৃশ্যত ঘামছেন না তখনও। ডাঃ কোহেন সতর্ক করে বলেন, হালকা ডিহাইড্রেশন হিট ক্র্যাম্পস বা হিট স্ট্রোকের মতো তাপ-সম্পর্কিত অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। গরম আবহাওয়ায় প্রতি ঘন্টায় বাইরে থাকলে বা ব্যায়াম করলে কমপক্ষে ১৬ আউন্স অতিরিক্ত তরল যোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।
২. তৃষ্ণাকে হাইড্রেশনের নির্ভরযোগ্য ইঙ্গিত মনে করা: "তৃষ্ণা একটি সহায়ক সংকেত হলেও, এটি গাড়ির গ্যাস গেজের 'ই' সংকেতের মতো দেরিতে আসা একটি সতর্কীকরণ বাতি," বাজিলিয়ান বলেন। অর্থাৎ, যখন আপনি তৃষ্ণার্ত বোধ করেন, তখন আপনি ইতিমধ্যেই কিছুটা ডিহাইড্রেটেড। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া কম সংবেদনশীল হয়। ডাঃ কোহেনের মতে, হাইড্রেশনে সামান্যতম হ্রাসও শারীরিক ও জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতা ব্যাহত করতে পারে। তার মতে, হাইড্রেশন স্ট্যাটাস পরিমাপের ভালো উপায় হলো কত ঘন ঘন বাথরুমে যাওয়া (প্রতি ২-৩ ঘন্টা পর পর) এবং প্রস্রাবের রং দেখা (স্বচ্ছ থেকে হালকা হলুদ)।
৩. শুধুমাত্র পানীয় থেকে হাইড্রেশন: আমাদের তরল গ্রহণের প্রায় ২০ শতাংশ আসে উচ্চ জলের উপাদানযুক্ত খাবার থেকে — যেমন ফল, শাকসবজি, স্যুপ, স্ট্যু। বাজিলিয়ান উল্লেখ করেন, তরমুজ, শসা, টমেটো, বেরি, আঙ্গুর এবং সবুজ শাকসবজি সবই দুর্দান্ত হাইড্রেশন বিকল্প। এমনকি স্মুদি এবং ঠান্ডা স্যুপ যেমন গ্যাজপাচোও গণনা করা হয়।
৪. একবারে অনেক পানি পান করা স্বাস্থ্যকর মনে করা: বিশ্বাস করুন বা না করুন, অতিরিক্ত পানি পান করা সম্ভব, যাকে হাইপোনাট্রেমিয়া বলা হয়। এতে শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে কমে যায়, যার ফলে বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা, বিভ্রান্তি এবং গুরুতর ক্ষেত্রে খিঁচুনি হতে পারে। বাজিলিয়ান বলেন, এটি বিরল এবং সহনশীল ক্রীড়াবিদদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। সাধারণত, একবারে অনেক পানি গিলে ফেলার চেয়ে সারাদিন ধরে নিয়মিত চুমুক দিয়ে পানি পান করা বেশি কার্যকর, কারণ এতে শোষণ ভালো হয়।
৫. ক্যাফেইন ডিহাইড্রেশন ঘটায় এমনটা মনে করা: "এই মিথটি সত্যিই দূর করা দরকার," বাজিলিয়ান বলেন। "কফি এবং চা অবশ্যই আপনার হাইড্রেশনে ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি, কফি এবং চা পানি দিয়েই তৈরি হয়।" একইভাবে, স্পার্কলিং ওয়াটার (বা সেল্টজার) ডিহাইড্রেশন ঘটায় না; এটি সাধারণ পানির মতোই হাইড্রেটিং।
৬. ওয়ার্কআউটের সময় স্পোর্টস ড্রিঙ্কস পানির চেয়ে ভালো মনে করা: স্পোর্টস ড্রিঙ্কস সব সময় পানির চেয়ে ভালো নয়। লেসলি বনসি, একজন স্পোর্টস ডায়েটিশিয়ান, বলেন এটি নির্ভর করে আপনি কতক্ষণ এবং কতটা কঠিন ব্যায়াম করবেন। এক ঘন্টার কম সময়ের জন্য হালকা ব্যায়ামে পানিই যথেষ্ট। তবে যদি আপনি বেশি ঘামেন বা এক ঘন্টার বেশি সময় ধরে তীব্র ব্যায়াম করেন, তবে কম চিনিযুক্ত ইলেক্ট্রোলাইট পাউডার থেকে সোডিয়াম এবং পটাসিয়ামের মতো ইলেক্ট্রোলাইট যোগ করা ভালো। তিনি আরও পরামর্শ দেন, ব্যায়ামের এক ঘন্টা আগে ২০ আউন্স তরল পান করা উচিত এবং ওয়ার্কআউটের সময় প্রতি ২০ মিনিটে কয়েক চুমুক এবং শেষে অতিরিক্ত ২০ আউন্স পান করা উচিত।
তথ্য:ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
ডিবিসি/ জেআরওয়াই