বাংলাদেশ, জাতীয়

প্রবাসী পুনর্বাসন: আইনে আছে, বাস্তবে নেই!

সাবিনা পুঁথি

ডিবিসি নিউজ

রবিবার ২রা এপ্রিল ২০২৩ ০৭:০২:১২ পূর্বাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

এপিডব্লিউএলডি ফেলোশিপ প্রতিবেদন: দীর্ঘ প্রায় ৫ দশক ধরে বিদেশে কর্মী পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিটেন্স এখনো দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চালিকা শক্তি। কিন্তু অর্থনীতি সচল রাখা প্রবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে ও প্রতারণা ঠেকাতে দীর্ঘ ৪৭ বছরেও কার্যকর কাঠামো কিংবা ফলপ্রসু দীর্ঘমেয়াদী কোন পদক্ষেপ দেখা যায় নি।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের হিসাবে, ২০২২ সালে ৯৭ হাজার ৯২০ জন আউট পাশে দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফিরেছে সৌদি আরব থেকে। নানা কারণে বিদেশে পাসপোর্ট না থাকলে বা বিপদে পড়ে কোনভাবে পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে সেসব দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফহোমে আশ্রয় নেওয়া কর্মীদের আউটপাশে ফেরত পাঠানো হয়। 

এক বছরে প্রায় ১ লাখ কর্মীর আউটপাসে ফেরত আসার বিষয়ে বিমানবন্দরে প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের এক কর্মকর্তা জানান- ‘মুলত কর্মীদের কারো পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে, কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে দেশে ফিরতে না পারলে, অবৈধ হয়ে গেলে, অসুস্থ হয়ে থাকলে কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়ে মালিকের বাসা থেকে পালিয়ে দূতাবাসের সেইফহোমে আশ্রয় নিলে কিংবা রাস্তায় বেওয়ারিশ হিসেবে পাওয়া গেলে তাদের দূতাবাসের সহায়তায় আউটপাশে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তাদের বেশিরভাগেরই পাসপোর্ট না থাকায় আউটপাশে ফেরেন, যাদের বড় সংখ্যাই ফেরেন প্রতারিত হয়ে।’

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের হিসেবে গত কয়েকবছরে শতাধিক নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফিরেছে। কেউ কেউ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে সন্তান নিয়ে ফিরেছেন, কেউ বিদেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে ‘আত্মহত্যা’ বলে মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাদের দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান কিংবা রি-ইন্টিগ্রেশনের কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই। ঘটনা অনুসন্ধানে দেখা গেছে বিদেশ প্রত্যাগত নির্যাতিত নারীদের ক্ষেত্রে সুরক্ষায় কিংবা আর্থিক সহায়তায় আজ পর্যন্ত কার্যকর দীর্ঘমেয়াদী কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় নি। সৌদিসহ বিভিন্ন দূতাবাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে প্রতিবছর গড়ে ৬ শতাধিক নারী কর্মী মধ্যপ্রাচ্যে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরে। কিন্তু নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরাদের জন্য এখন পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদে সরকারের কোন প্রবাসী আশ্রয়কেন্দ্র বা সুরক্ষা সেন্টার নেই। 

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের হিসেবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ নারী কর্মী বিদেশ যায়, তার মধ্যে গড়ে ৫% কর্মী নানা ধরনের ভালনারেবিলিটি বা নির্যাতন নিয়ে দেশে ফিরছে। 



খোঁজ রাখছে না কেউ!
শিকলে বন্দী জীবন: ২০১৬ সালে সৌদি আরব থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেরেন মানিকগঞ্জের বিউটি আখতার। ২ বছরের মাথায় ফেরেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে। বিমানবন্দর থেকে তাকে উদ্ধার করে পুলিশের সহায়তায় পরিবারের কাছে দেয়া হয়। রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটে কিছুদিনের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পরে আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় বাড়ি নিয়ে যায় পরিবার। 

বিউটি আখতারের মা তাকে শিকল পড়িয়ে রাখেন। ৭ বছর ধরে শিকলে বন্দী জীবন তার। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে দেখা মেলে বিউটি আখতারের। হাতে পায়ে শিকল জড়ানো, অপরিচিত কাউকে দেখলেই অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন, কখনো মারতে তেড়ে আসেন, হাতে থাকা জিনিস ছুড়ে মারেন। বিউটি আখতারের মা রাবেয়া খাতুন কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ‘সারাদিন একে ওকে গালি দেয়, কেউ বাড়িতে বেড়াতে আসতে চায় না, আসেও না। আমার ছেলে ঢাকায় আলাদা থাকে। ওরাও ভয় পায় ওকে নিয়ে। আমার ক্ষতি করে বসে কি না কিন্তু আমি তো মা, ছেড়ে যেতে পারি না।’

রাবেয়া খাতুনের পরিবারে তাই বলতে গেলে মেয়ে আর মা। বিউটি আখতারের স্বামী তাকে ছেড়ে গেছে, একটি ছেলে অন্যত্র থেকে পড়াশুনা করে। একমাত্র সন্তানকে বড় করতে বিদেশ পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, স্থানীয় এক দালালের সহায়তায় বৈধভাবেই গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন কিন্তু ফেরেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে। 

 

২০১৬ সালে যখন বিউটি ফেরত আসেন তখন সরকারি ও বেসরকারিভাবে ১ লাখ টাকার অর্থ সহায়তা পেয়েছিলেন। কিন্তু পরে কেউ আর কোন খোঁজ রাখে নি। এ বিষয়ে রাবেয়া খাতুন আক্ষেপ জানিয়ে বলেন, ‘যখন দেশে ফেরে তার পরে অনেক নিউজ বেরিয়েছিলো তখন সরকারিভাবে ১ লাখ টাকা দেয়া হয়েছিলো। পরে আর কেউ খোঁজ নেয় নি।‘ ফলে এখন শিকল পড়েই কাটছে বিউটির ঘর বন্দী জীবন। 

সাধারণত সরকারিভাবে কাউকে কাউকে এককালীন কিছু অর্থ সহায়তা দিলেও এসব ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। অনেক সময় মিডিয়ায় আলোচিত হলে কিছু অর্থ সহায়তা দেয় বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও কিন্তু তাও অপ্রতুল। ফলে বিদেশ থেকে অসহায় বা নির্যাতিত হয়ে ফিরলে এয়ারপোর্ট থেকে ব্যক্তির নিজের বাসায় পৌছে দেয়ার মতোও কেউ থাকে না। নির্দিষ্ট কোন কাঠামো বা সেন্টার না থাকায় এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ, পুলিশ এমনকি প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাছে ভিকটিমদের হস্তান্তর করে থাকে। 

নির্যাতিতদের জন্য নেই দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন কেন্দ্র কিংবা আর্থিক সহায়তা-
বিদেশে নির্যাতিত বা ক্ষতিগ্রস্তদের দীর্ঘমেয়াদে পুনর্বাসন বা আশ্রয় দানে সরকারের নিদিষ্ট কোন সেইফহোম বা আশ্রয়কেন্দ্র নেই। তবে গতবছর সরকারিভাবে বিদেশগামী ও বিদেশ প্রত্যাগত কর্মীদের সাময়িক অবস্থানের জন্য বিমানবন্দরের কাছে "বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টারের উদ্বোধন করা হয়। ৪৮ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে, ২০০ টাকা প্রদানের মাধ্যমে সবোর্চ্চ ২ দিন অবস্থান করা যাবে। 

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে: 
ব্র্যাক– প্রবাসী কর্মীরা ছাড়াও অন্য ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিমানবন্দরের কাছে আশকোনায় হজ ক্যাম্পের পাশেই ৩৫০ আসনবিশিষ্ট ১টি সেইফহোম রয়েছে ব্র্যাকের। জরুরি অবস্থা বিবেচনায় বিদেশ ফেরতদের স্বল্প সময়ে আশ্রয় দেয়া হলেও সাধারণত পরিবারের কাছে হস্তান্তরই করা হয়। বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের পরিস্থিতি বিবেচনায় ৩-৪ দিন অবস্থান করার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। খাদ্য, মানসিক কাউন্সেলিং, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।   

বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র (বিএনএসকে)- সে অর্থে সেইফহোম নেই, তবে জরুরি প্রয়োজনে একসঙ্গে ৩-৪ জনকে সেবা দেয়ার মতো ছোট একটি কক্ষের ব্যবস্থা রয়েছে রাজধানীর শ্যামলীতে। ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫ জনকে সেবা দেয়া হয়েছে। 

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)- ঢাকা বিমানবন্দর থেকে খানিকটা দুরে যাত্রাবাড়ি, দনিয়ায় ওকাপের মুল অফিস, তার পাশেই ছোট পরিসরে একটি ফ্ল্যাটে ২ টি কক্ষে সেইফহোমের ব্যবস্থা রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে থাকার সুযোগ নেই এখানেও। পরিবার গ্রহণ করা পর্যন্ত এখানে অল্প কয়েকদিন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। মুলত ২০১৩ সাল থেকে চালু হওয়া এ সেইফহোমে নারীদের জন্য ৬ বেড ও পুরুষদের জন্য কয়েকটি বেড রয়েছে। এখানে ২০২০ জানুয়ারি- ২০২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩২৩ জনকে সেবা দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ২৩৬ জনই নারী। 

রিফিউজি এন্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)- ২০১৮ সাল থেকে দক্ষিণ খানে ছোট পরিসরেই অস্থায়ী সেইফহোমের ব্যবস্থা রয়েছে রামরুর। এ পর্যন্ত ২৭ হাজার বিদেশ ফেরত ও বিদেশগামীকে বিভিন্ন সেবা দেওয়ার কথা জানিয়েছে রামরু। পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা পর্যন্ত ৬-৮ দিন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। রিইন্ট্রিগ্রেশনের ক্ষেত্রে কিছু আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। সবোর্চ্চ ৮-১০ জনের মতো থাকার আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।  

বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন (বোমসা): ইমার্জেন্সি সাপোর্ট দেয়ার জন্য একটি কক্ষ আছে, যেখানে ৬-৭ জনের মেঝেতে থাকার ব্যবস্থা আছে। রাজধানীর দারুস সালাম, মিরপুরে বোমসার অফিসে এই কক্ষের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ১৫ হাজারের বেশি অভিবাসী কর্মীকে খাদ্য, চিকিৎসা, মানসিক সুরক্ষাসহ প্রাথমিক সাপোর্ট দিয়েছে বোমসা। তবে, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কারোরই অভিবাসী কর্মীদের বড় বা মাঝারি ধরনের আর্থিক সহায়তা বা দীর্ঘ মেয়াদে আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার মতো সুরক্ষা সাপোর্ট নেই। পরিবারের কাছে পৌছে দেয়ায় মুল লক্ষ্য।   

অর্থ্যাৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কারোরই সে অর্থে কোন সেইফহোম নেই, যেখানে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীরা আশ্রয় নিতে পারে। তাদের আছে অস্থায়ী বা সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র। 

সরকারিভাবেও সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের অধিনে এতিম শিশুদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র থাকলেও প্রবাসে নির্যাতিত নারীদের জন্য দেশে দীর্ঘমেয়াদী কোন সেইফ হোম বা পুনর্বাসন কেন্দ্র নেই। খোঁজ নিয়ে যেসব তথ্য জানা গেছে তার মধ্যে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের যে সেইফহোম বা আশ্রয়কেন্দ্র  রয়েছে ঢাকা আন্তার্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে, সেখানে বিভিন্ন সময় বিদেশ ফেরত অসহায় কর্মীদের আশ্রয় দেয়া হয়। তবে তা অস্থায়ী ভিত্তিতে। মুলত প্রাথমিক আশ্রয় হিসেবে পরিবারের কাছে হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত সেখানে রাখা হয়। ব্র্যাক অভিবাসন বিষয়ক কর্মসূচির হিসাবে গত ৪ বছরে ২৬ হাজার মানুষকে নানাভাবে সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২ হাজার জন নারী যাদের মধ্যে অন্তত শতাধিক নারীকে মানসিকভাবে বির্পযস্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং সন্তান নিয়ে বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরেছে বলে জানিয়েছে ব্র্যাক। 

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান সমন্বয়ক শরিফুল হাসান জানান- এয়ারপোর্টে ফেরত আসা যে কোন ক্রিটিকাল কেসের ক্ষেত্রে বাচ্চা নিয়ে ফিরলে, কিংবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফিরলে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, এয়ারপোর্ট পুলিশ, ইমিগ্রেশন কোন তথ্য দিলে আমরা চেষ্টা করি ব্র্যাকের অর্থায়নে তাদের খাবার, কাউন্সেলিং, বাসস্থান, মেডিক্যাল বা ট্রিটমেন্ট দেয়ার। সাধারণত কয়েক ধরনের সাপোর্ট লাগে- আসার পরপরই ২৪-৭২ ঘন্টার মধ্যে তাদের যে ধরনের হেল্প লাগে, যেগুলোকে আমরা নাম দিয়েছি ইমার্জেন্সি সাপোর্ট।

কিন্তু যদি কোন নারী খুব নির্যাতিত ও অসহায় হয়ে আসে, বাচ্চা নিয়ে বা নির্যাতিত বা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে আসে, তাহলে তাকে দেখভালের জন্য যে ধরনের সুরক্ষা কাঠামো বা যে ধরনের সেইফহোম দরকার সে ধরনের সেইফ হোম, বিদেশ ফেরত নারীদের জন্য কারোরই নেই। আমদের যেটা আছে আমরা বিদেশ ফেরত নারী বা পুরুষদেরদের কেউ আসলে এয়ারপোর্ট থেকে তার থাকার দরকার হলে সে ধরনের ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা আমরা করি। কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদে নয়, আমরা ৩-৪ দিন সাপোর্ট দিতে পারি কিন্তু মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর রাখা সম্ভব নয়, তাতে অন্যদের আমরা সেবা দিতে পারবো না।

নারী অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে কাজ করা অন্য সংস্থাগুলোর মধ্যে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র (বিএনএসকে)। সে অর্থে কোন সেইফহোম নেই, রাজধানীর শ্যামলীতে বিএনএসকের একটি কক্ষ রয়েছে যেখানে ৩-৪ জন নারী কর্মীকে সেবা দেয়া যায়। ২০২১ সালে মহামারির সময় থেকে এই সেবা চালু করেছে বিএনএসকে। মুলত বিদেশগামী কর্মীরা যারা বিভিন্ন জেলা থেকে আসেন তারা ফ্লাইটের আগে কিছুসময়ের জন্য এখানে থাকতে পারবেন।

বিএনএসকের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম জানান- এ পর্যন্ত তাদের সেল্টার হোমে ৫ জনকে সেবা দিতে পেরেছেন, যাদের মধ্যে একজন গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। 

একটা সামগ্রিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সুমাইয়া ইসলাম বলেন, ‘বিমানবন্দরে যে লক্ষ্য নিয়ে সরকার বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ সেন্টার করেছে সেটার কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করা জরুরি। সেখানে দুটা সেক্টর করা জরুরি, একটা স্বল্প মেয়াদে সাপোর্ট, অন্যটা দীর্ঘমেয়াদে। এটার সামগ্রিক একটা কাঠামো সরকারকেই দাঁড় করাতে হবে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাটেজের থেকে বেশি কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। 

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা- কর্মজীবী নারী এর অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক ও এপিডব্লিউএলডি অভিবাসন প্রোগ্রামের পিওসি সদস্য সানজিদা সুলতানা বলেন, ‘প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়েরই দায়িত্ব যে বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটা সেইফহোম বা সেইফ সেন্টার তৈরি করা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে যখন ফ্লাইটগুলো আসে তখন খোঁজ রাখা এরকম নির্যাতিত হয়ে কেউ ফিরছে কি না। অথ্যাৎ রিপ্যাট্রিয়েশনের পুরো একটা সিস্টেম তৈরি করা। তাদের আশ্রয় দিয়ে পরিবারের কাছে ফেরা কিংবা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সরকারের অর্থ সহায়তা দেয়া। বেসরকারি সংস্থাগুলো আংশিক একটা সাপোর্ট দিতে পারে কিন্তু ম্যানডেট তো সরকারের। বেসরকারি সংস্থাগুলোর নিজস্ব কোন তহবিল থাকে না, তারা কোন না কোন প্রকল্পের আওতায় থাকে। সেটার অনেক সীমাবদ্ধতাও থাকে। অভিবাসী কর্মী প্রেরণ একটা চলমান প্রক্রিয়া, অনেক আগে থেকেই যাচ্ছে সামনেও যাবে। ফলে সামগ্রিক একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে, সেটা সরকারকেই করতে হবে।  
 
নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরাদের ঘটনা অনুসন্ধানে গুরুত্ব কম-  
‘মাথায় মারতো খালি, আর মাথা খারাপ হয়ে যাইতো, কোন কাজ-কাম পারতাম না’– বলছিলেন সৌদি ফেরত গৃহকর্মী নাসিমা আখতার (ছদ্মনাম)। ২০২২ সালের ১লা মে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফেরেন নাসিমা আখতার (ছদ্মনাম) । গৃহকর্মী হিসেবে ২০২১ সালে সৌদি আরব গিয়ে ১ বছরের মাথায় ফেরত আসেন। কিছু টাকা পাঠাতে পারলেও শেষে কয়েক মাসের বেতন আটকে দেয় গৃহকর্তা। নাসিমা আখতারের (ছদ্মনাম) বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে। তার বাড়িতে গিয়েই কথা হয় নাসিমা ও তার পরিবারের সাথে। ২ সন্তান রেখে পরিবারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে বিদেশ যান কিন্তু অর্থাভাবে এখন তার চিকিৎসায় করাতে পারছেন না তার স্বামী মজিবর রহমান। 

নাসিমা আখতার জানান, ‘বাইরে অনেক কাজকর্ম, বাড়ির অনেক কাজ করতে হতো- ঘরদোর মুছা, থালাবাসন মাজা, ধোয়া । বেতন কম দিতো। বেতন কম দিলে কাজ করব কি করে, বেতন বাড়াবে না কয়ে দিত। মারতো, কাজ না করলে অসুস্থ হলে খাইতে দিতো না। হাত-পিছে, শরীরে লাঠি দিয়ে মারতো, যে কদিন ছিলাম সে কদিনই মারতো। আমার অসুখ হলেও কাজ করতে বলতো, না করলে মারতো।’

রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে জানাইছিলাম যে মারধর করে, কিন্তু এজেন্সি বলে মারধর করে তো কি হয়েছে ওখানেই থাক। 

শান ওভারসিজ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ যান নাসিমা। অসুস্থ হওয়ার পরে ৩ মাস ধরে আর কোন বেতন পান নি। পরে পরিবার তাকে ফেরত আনে। নির্যাতনের বেশিরভাগ গল্পগুলোই এমন, কিন্তু তারপরও ঘটনাগুলোকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফলে বছরের পর বছর একই ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। এমনকি প্রতিবছর নাসিমার মতো কত কর্মী এ ধরনের পরিস্থিতিতে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরছেন তার কোন তথ্য নেই কারো কাছে, আগ্রহও নেই।

সানজিদা সুলতানা বলেন, ‘ঠিক কি পরিমাণে কর্মী নির্যাতিত হয়ে ফিরছে তার ডাটা বা তথ্য সরকারের কাছেও নেই। সরকার শুধু বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চায় যে তারা আমাদের মাধ্যমে যায় নি। কিন্তু তারা তো বাংলাদেশের নাগরিক এবং তারা অনেক রেমিটেন্সও পাঠাচ্ছে।’

প্রতিবছর গড়ে ৮-১০ লক্ষ কর্মী কাজ নিয়ে বিদেশ যায়, যার মধ্যে ১ লক্ষ্যেরও বেশি নারী কর্মী। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি নারী গৃহকর্মী যায় সৌদি আরব, প্রতিবছর ৭০-৯০ হাজার। কিন্তু, প্রতিবছর কত সংখ্যক কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরছে তার যেমন সঠিক হিসাব নেই তেমনি স্বাভাবিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে নারী কর্মীদের কি ধরনের সমস্যা রয়েছে ও সেগুলোর সমাধান নিয়েও কোন গবেষণা নেই।  
 
বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল জেদ্দা, সৌদি আরবের তথ্য অনুসারে ২০২১ সালে এক বছরে ১২ হাজার ৮৬০ জনকে ডিপোর্টেশন সেন্টারে আইনি সহায়তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া সেইফহোম ব্যবস্থাপনায় থাকা ১০৬ জন গৃহকর্মীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। 

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের হিসেবে এ ধরনের ঘটনায় তাদের মাধ্যমে গত এক বছরে ৫০ জন বিদেশ ফেরত কর্মী ক্ষতিপূরনের জন্য বিএমইটিতে লিখিত আবেদন জানায়, যার মধ্যে ২৫ জন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশিরভাগ বিদেশ প্রতারিত প্রবাসী কর্মীরা জানেনই না কোথায় আবেদন জানাতে হয়, কি ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওকাপের হিসাবে, গত ৩ বছরে ৩২৩ জন বিদেশ ফেরত প্রবাসী কর্মী তাদের সেইফহোমে প্রাথমিক আশ্রয় নিয়েছিল যার মধ্যে ২৫২ জনের অবস্থায় ছিলো শারিরীকভাবে অনেক খারাপ।  

অন্যদিকে বিএমইটির তথ্য অনুসারে বর্তমানে ২৫৮ টি রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে, বাতিল হয়েছে ৫১টি এজেন্সির। স্থগিত হওয়া এজেন্সিগুলোর বেশিরভাগই মানবপাচারসহ নানা অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত। আদালত ও পুলিশ সূত্র মতে, মানবপাচার সংক্রান্ত ৫ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন আছে। তবে বিদেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত দেশে কোন ধরনের মামলার বিচার নিষ্পত্তির উদাহরণ নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসামিরা জামিনে পার পেয়ে যায় এবং বিচার না হওয়ার কারণে এ ধরনের প্রতারণা ও নির্যাতন কমছে না। এমনকি আলোচিত ঘটনা সেৌদিতে আবিরণ হত্যা মামলায় বিদেশে মৃত্যুদন্ডের রায় হলেও বাংলাদেশে মামলা এখনো বিচারাধীন এমনকি আসামিরা জামিনে মুক্ত। ফলে বিচারহীনতার কারণে দালালরা বেপরোয়া হয়ে তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। 

এইচআইভি নিয়েও ফিরছে অনেকে: গ্রহণ করতে চায় না পরিবার:
২০২০ সালে এইচআইভি ভাইরাস পজিটিভ হয়ে দেশে ফেরে ২ জন নারী কর্মী। বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন (বোমসা) এর সহায়তায় তাদের বিমানবন্দর থেকে অফিসে নেয়া হয়। দীর্ঘ ১০ বছর পরিবারের জন্য রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন তারা। কিন্তু পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা সামাজিকতার ভয়ে তাদের গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। বোমসার সাধারণ সম্পাদক, উন্নয়নকর্মী শেখ রুমানা সেই সময় বিদেশ ফেরত ওই দুই নারী কর্মীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেন।

তিনি বলেন- ‘তারা দীর্ঘ সময় পরিবারকে সহযোগিতা করলেও এই পরিস্থিতিতে তারাও মুখ ফিরিয়ে নেয়। সেক্ষেত্রে সরকারের সমন্বিত কোন উদ্যোগ বা পুনর্বাসন বা আশ্রয় কেন্দ্র থাকলে তারা সেখানে আশ্রয় নিতে পারতেন। কিন্তু এরকম কোন ব্যবস্থা না থাকায়, পরিবারকে বুঝিয়ে তাদের কাছেই পৌছে দেই আমরা। যদিও সেখানেও নিগ্রহের শিকার হতে থাকে তারা।’

যারা ১০-১৫ বছর পর্যন্ত বিদেশে কাজ করে দেশে ফেরে তাদের পেনশন ভাতা চালু করারও প্রস্তাব দেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার নারী কর্মীকে চিকিতসা প্রদানের ব্যবস্থা করে বোমসা, যাদের শারিরীক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিলো। শরীরে নানা রকমের রোগ নিয়ে অনেকেই জেল খেটে ফেরত এসেছেন, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু ঝুকিঁ নিয়েও ফিরেছেন। তবে তার সঠিক কোন হিসাব নেই কারো কাছে। 

তবে ঢাকার অদূরে গাজীপুরে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির একটি সেইফহোম রয়েছে সেখানেও কোন কোন বিদেশ প্রত্যাগত প্রবাসী নারী কর্মীদের রাখা হয়। তবে, সেখানে অবস্থা বিবেচনায় সামগ্রিক সব নারীদেরই রাখা হয়। 

প্রতারিত নারী কর্মীদের সাথে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে তাদের সন্তানরাও:
ঘটনা-১ : ছোট্ট ৩ শিশু সন্তান ও স্ত্রীকে রেখে পালিয়ে যায় নরসিংদীর হাজেরা বেগমের স্বামী। দরিদ্র সংসারে ৩ শিশু সন্তানকে পড়ালেখা শেখাতে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে গতবছর পাড়ি দেন সৌদি আরব। কিন্তু মাত্র ১৪ দিনের মাথায় গৃহকর্তার বাড়িতে মারা যান হাজেরা বেগম। পরিবারের দাবি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, কিন্তু ঘটনাটি নেহাত আত্মহত্যা বলে মরদেহ দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়, পোস্ট মর্টেম ছাড়াই। হাজেরা বেগমের মৃত্যুতে অবিভাবকহীন হয়ে পড়ে ৩ শিশু। পরে, একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় ৩ শিশুকে একটি এতিম খানায় দেওয়া হয়। 

ঘটনা-২: কুমারী মেয়েদের সন্তান নিয়ে ফেরা নতুন কোন ঘটনা নয়!
সুনামগঞ্জের ১৮ বছর বয়সী অবিবাহিত ময়না (ছদ্মনাম) ৪ বছর পর দেশে ফেরে সন্তান নিয়ে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ৬ মাসের সন্তান নিয়ে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০২২ জেদ্দা থেকে দেশে ফেরে। জনশক্তি রপ্তানি ব্যুরো (বিএমইটি) ছাড়পত্র না নিয়েই রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স বি.এস ইন্টারন্যাশনাল গৃহকর্মীর কাজ দিয়ে সেৌদি আরব পাঠায়। সৌদি আরব যাওয়ার পর থেকে পরিবারের সাথে তার সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
               
এজেন্সি ও দালালের সাথে যোগাযোগ করে না পেয়ে ময়না মারা গেছে ভেবে পরিবারও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ৪ বছর পর সন্তান নিয়ে দেশে ফেরে ভারসাম্যহীন অবস্থায় ঘোরাফেরা করতে দেখে বিমানবন্দর পুলিশ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের কাছে হস্তান্তর করলে তাদের সেইফহোমে আশ্রয় হয় ময়নার। পরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু পরিবার গ্রহণ না করলে চরম বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এসব অভিবাসী নারী কর্মীদের। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বোমসা’র হিসেবে, ২০০৯ সাল থেকে ৩৫ জন অভিবাসী নারী কর্মীকে সেবা দিয়েছে যারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে সন্তান নিয়ে দেশে ফিরেছে।

এর মধ্যে ২০২১ সালে একসঙ্গে ১১ জন গর্ভবতী মাকে দেশে ফেরত আনা হয়। তাদের মধ্যে ১টি শিশু এখনো খুলনার এসওএস শিশু পল্লীতে বেড়ে ওঠছে। বাকিদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তৃণমুল সংস্থাটি যেসব দেশে কাজ করে তার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, ওমান, বাহরাইন, জর্ডান, দুবাই এবং লেবানন। তবে এসব দেশের মধ্যে নারী কর্মীরা সৌদি ও লেবাননেই বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরে বলে জানায় সংস্থাটি। 

যেসব ঘটনাগুলো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে কিংবা মিডিয়ায় আলোচিত হয় সাধারণত সেসব ঘটনায় সরকারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ত্বরিত গতিতে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তরকেই গুরুত্ব দেয় বেশি। বিদেশ ফেরত এসব কর্মী ও শিশুদের জন্য আলাদা সমন্বিত কোন কর্মসূচি না থাকায় দেশে ফিরেও চরম অবহেলা ও দারিদ্রতার মধ্যে দিন কাটাতে হয় ভুক্তভোগি মা ও তাদের সন্তানদের।  
  
তবে অভিবাসন বিষেজ্ঞদের মতে, রাজধানীর আজীমপুরে ছোটমনি নিবাসের মতো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধিনে থাকা শিশু কেন্দ্র গুলোতে মায়েদের থাকার ব্যবস্খা নেই। ফলে অসহায় মায়েরা চরম দারিদ্রতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও সন্তানকে এসব কেন্দ্রে আলাদা রাখতেও অনাগ্রহ প্রকাশ করে থাকে।    

আলোচনাতেই আটকে প্রবাসী পুনর্বাসন প্রকল্প
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আইন ২০১৮ অনুসারে, ৯ এর (ক) তে নির্যাতনের শিকার নারী অভিবাসীদের কল্যাণে দেশে-বিদেশে সেইফ হোম পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। দেশে প্রত্যাগত নারী অভিবাসী কর্মীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কথাও বলা আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে অর্থে অভিবাসী নারীদের জন্য দেশে কোন সেইফ হোম নেই।

চিত্র: ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আইন ২০১৮ অনুসারে ধারা ৮ ও ৯ এ উল্লেখ রয়েছে পুনর্বাসনের কথা-



বিদেশগামী এবং বিদেশ ফেরত কর্মীদের সাময়িক অবস্থান বা রাত্রিযাপনের আবাসস্থল হিসেবে সম্প্রতি বিমানবন্দরের কাছে যে ‘বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার’ তৈরি করা হয়েছে সেখানে সবোর্চ্চ ২ দিন পর্যন্ত অবস্থানের সুযোগ রয়েছে। তবে ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ডের অর্থায়নে নির্মিত সেই সেন্টারে অভিবাসীদের জন্য সেইফ হোম এবং ট্রেনিং সেন্টার তৈরীর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন হয় নি। 

প্রবাস ফেরত প্রতারিত বা নির্যাতিতদের জন্য কোন পরিকল্পনা আছে কি না এমন প্রশ্নে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংমস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ জানান- ‘বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার আসলে সেইফহোম না। একটি অস্থায়ী সেন্টার যেখানে প্রবাসীরা বিদেশ যাওয়া বা আসার পথে আশ্রয় নিতে পারেন তার একটা সুবিধা করে দেয়াই এর মুল উদ্দেশ্য। আমরা কিছু ট্রেনিং সুবিধা সেখানে করবো যেমন পিডিও, ডেমো যেগুলো টিটিসিতে করি সেগুলো সেখানে করার কিছু পরিকল্পনা আছে। 

তবে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরা মহিলাদের জন্য আলাদা পরিকল্পনা আছে কিন্তু সেটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। রি-ইন্টিগ্রেশন প্রোগ্রামের আওতায় করতে হবে, যেটা এখনো আমরা করতে পারি নি। এটার সাথে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত আছে, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়েরও ভুমিকা আছে। কিন্তু দুভার্গবশত সমন্বিত কোন প্রচেষ্টা এখনো নেই। এটা নিয়ে সমন্বিতভাবে কিছু করতে আমাদের আলোচনা চলছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে,  বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় সরকারের একটি নতুন পুনর্বাসন প্রকল্প রয়েছে তবে তা এখনো বাস্তবায়ন পর্যায়ে আসে নি। এই প্রকল্পের আওতায় করোনাকালীন বিদেশ ফেরত ২৫ হাজার কর্মীকে ট্রেনিং ও সবোর্চ্চ ১৩ হাজার করে এককালীন অর্থ সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
 
সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি!
বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ সেন্টারের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্ষমতা বাড়ানো: অভিবাসী কর্মীদের পুনর্বাসন কিংবা সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় এখন পর্যন্ত সরকারীভাবে সমন্বিত কোন উদ্যোগ নেই। অভিবাসীদের নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসী কর্মীদের সহায়তায় কিছু কাজ করলেও তা অত্যন্ত অপ্রতুল। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেরা অভিবাসী কর্মীদের ক্ষেত্রে তাদের কেবল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ফলে পরিবারগুলো দারিদ্রতার কারণে দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা কিংবা সামাজিক সুরক্ষার বিষয়গুলো উপলদ্ধি করতে পারে না।  

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচীর প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘বিদেশ ফেরতদের থাকার জন্যে সরকারিভাবে বঙ্গবন্ধু ওয়েব আর্নার্স সেন্টার যেটা করা হয়েছে সেটার কার্যক্রম বা পরিধি যদি বাড়ে তাহলে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি নারীদের জন্যও একটা দীর্ঘমেয়াদী আশ্রয় সেন্টার হতে পারে। তবে সার্বিকভাবে প্রবাসী নারীরা যে ধরনের নির্যাতনের শিকার হোন সে অনুসারে অনেক কার্যক্রম হাতে নেওয়া দরকার। খুব জরুরি অবস্থায় ফিরলে কি ধরনের সাপোর্ট দরকার, কেউ বাচ্চা নিয়ে ফিরলে কি ধরনের সাপোর্ট দরকার, কেউ নির্যাতিত বা গর্ভবর্তী হয়ে এলে কি ধরনের সহযোগিতা দরকার, মানসিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে আসলে তার কি ধরনের সাপোর্ট দরকার তার একটা সামগ্রিক কাঠামো গঠন করা দরকার যেখানে ডাক্তার, সাইকোলজিস্ট, আইনজীবীদের সামগ্রিক একটা ব্যবস্থা থাকবে। এবং সেই উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। সেক্ষত্রে বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ সেন্টারকেই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে রুপ দেয়া যেতে পারে বলে মত দেন তিনি। 

কল্যাণ ফি’র অর্থ প্রবাসীদের কল্যাণে পুনর্বাসনেও বরাদ্দ করা
আইন অনুসারে প্রতিটি বিদেশগামী কর্মীরা অভিবাসীদের কল্যাণে সরকার নির্ধারিত কল্যাণ ফান্ডে ৩ হাজার টাকা প্রদান করে থাকে। সে হিসেবে প্রতি বছর যে ৮-১০ লাখ কর্মী বিদেশ যায় তারা বছরে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার উপরে প্রদান করে থাকে। 

এ বিষয়ে রিক্রুটিং এজেন্সিদের সংগঠন বায়রা’র সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, বিদেশ গামী প্রতিটি কর্মী প্রবাসীদের কল্যাণে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে নির্ধারিত যে ফি প্রদান করে থাকে সেই অর্থ তো তাদের কল্যাণেই ব্যয় করা উচিত। যারা বিদেশ প্রত্যাগত প্রতারিত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফেরে তাদের কল্যাণে ব্যয় হওয়া উচিত। সেই অর্থগুলো কোথায় যায়? 

তার মতে অর্থের দিক থেকে কোন ঘাটতি নেই, কেবল উদ্যেগের অভাব। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের নানান কাজের মধ্যে রয়েছে – প্রবাসী জীবন মান উন্নয়নে কাজ করা, বিদেশে মারা গেলে তাদের মরদেহ দেশে আনয়ন, সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তিসহ নানান কর্মসূচী রয়েছে। এর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসী কর্মীদের পুনর্বাসনেও এই অর্থ ব্যয় হওয়া উচিত বলে মত অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের। 

বিদেশে মিশনগুলোর মধ্যে ৩টি দেশে বাংলাদেশের কেবল ৫টি সেইফহোম আছে- সৌদি আরবের জেদ্দা ১ টি ও রিয়াদে ২ টি, লেবাননে ১ টি ও ওমানে ১ টি। বিভিন্ন সময় বিদেশ ফেরত কর্মীদের ভাষ্য অনুসারে এসব সেইফহোমের সুযোগ সুবিধা আরো বাড়ানো জরুরি। অনেক ক্ষেত্রে সেদেশে কর্মীরা নির্যাতিত হলে বিদেশে মামলা পরিচালনার জন্য সহায়তা করে থাকে দূতাবাসগুলো, সেক্ষত্রে দীর্ঘমেয়াদে এসব সেইফহোমে অবস্থান করা জরুরি হয়ে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের জন্য। ফলে গুরুত্ব বিবেচনায় সব মিশনেই সেইফ হোম থাকা জরুরি বলে মনে করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

২০২১ সালের একটি হিসাবে দেখা যায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল জেদ্দা, সৌদি আরব থেকে ১ বছরে উদ্বৃত্ত অর্থ কল্যাণ বোর্ডে ফেরত পাঠানো হয় ১৭ কোটি ৭৬ লক্ষ। ২০২২ সালে শুধু ১ মাসে অর্থ ফেরত পাঠানো হয় প্রায় ১ কোটি। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সমন্বিত উদ্যোগ ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব অর্থ প্রবাসীদের পুনর্বাসন কার্যক্রমে ব্যয় করা উচিত মনে মত অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের।  

এ বিষয়ে রিফিউজি এন্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) পরিচালক মেরিনা সুলতানা বলেন,  ‘সার্বিক একটা কাঠামো খুব প্রয়োজন- নির্যাতিত কর্মীরা আসলে কোথায় যাবে, কে সাপোর্ট দিবে, কি করবে এরকম একটা কাঠামো খুব দরকার। বিচ্ছিন্নভাবে করার থেকে একটা সামগ্রিক কাঠামো দরকার যার নেতৃত্ব দিবে সরকার, অন্যরা আমরা যার যা আছে সাধ্যমত সব নিয়ে একসঙ্গে কাজ করবো।’ 

ডিবিসি/ এইচএপি

আরও পড়ুন