বর্তমান বিশ্বে চলমান রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা, আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব এবং বিশেষ করে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মাঝে আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। একদিকে যেমন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এক বৈশ্বিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে, তেমনি অতি সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে শুরু হওয়া যুদ্ধের কারণে এখন এক মহাবিপর্যয়কর নিউক্লিয়ার যুদ্ধের আশঙ্খা দেখা দিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে ভারত ও পাকিস্তান- দীর্ঘদিন ধরেই সীমান্ত সমস্যা, সন্ত্রাসবাদ ইস্যু এবং কাশ্মীর নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। তবে ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই দেশের মধ্যে কথিত সীমান্ত লঙ্ঘন, সামরিক মহড়া এবং একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে এক নতুন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
পাকিস্তানের তরফে একাধিকবার বলা হয়েছে, “ভারতের পক্ষ থেকে যদি সীমান্তে সামরিক আগ্রাসন চালানো হয়, তাহলে আমরা প্রতিক্রিয়ায় পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারে পিছপা হব না।”
অন্যদিকে, ভারতের নিউক্লিয়ার ডকট্রিন এ নো ফাস্ট ইউজ বলা হলেও দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা স্পষ্ট করেছেন যে, “ভারতের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে কারও সঙ্গে আপস করা হবে না।” এ অবস্থায় দু’পক্ষের পারমাণবিক প্রস্তুতি, উচ্চমাত্রার সামরিক সতর্কতা এবং যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক প্রচার—সবকিছু মিলে দক্ষিণ এশিয়ায় এক বিপজ্জনক পরমাণু সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এদিকে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের দেয়া তথ্যমতে, গত ২০শে এপ্রিল চীনের গবেষকরা পারমাণবিক অস্ত্রের বিকল্প হিসেবে একটি অ-পারমাণবিক বা হাইড্রোজেন-ভিত্তিক অস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায়। আর মাত্র ২ কেজি (৪.৪ পাউন্ড) হাইড্রোজেন-ভিত্তিক বোমাটি ১,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১,৮৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এর বেশি তাপমাত্রায় একটি অগ্নিগোলক তৈরি করেছে এবং এটি দুই সেকেন্ডেরও বেশি সময় যাবত টিকে ছিল।
এই হাইড্রোজেন বিস্ফোরণটি তুলনামূলক টিএনটি বিস্ফোরণের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি স্থায়ী হয়েছিল এবং কোনও পারমাণবিক পদার্থ ব্যবহার ছাড়াই পরিচালিত হয়েছিল। চীনের এই নন নিউক্লিয়ার হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা ছিল আসলে আমেরিকাসহ অন্যান্য সকল প্রভাবশালী এবং সামরিক পরাশক্তির জন্য সম্ভবত একটি বড় মেসেজ। এতে চীনের নিউক্লিয়ার আ্যন্ড থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্রের বাস্তব সক্ষমতা নিয়ে নতুন করে বিচার বিশ্লেষণ শুরু করেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামরিক বিশ্লেষকেরা।
আসলে চলতি ২০২৫ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব তৈরি হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় চরম মাত্রায় ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের প্রতি লজিস্টিক ও গোয়েন্দা সহায়তা কমিয়ে দিলে, রাশিয়া সুযোগ নিয়ে আবারও ইউক্রেনের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সামরিক অবকাঠামোতে প্রচণ্ড ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। তার পাশাপাশি প্রয়োজনে ইউক্রেন এবং পশ্চিমা বিশ্বের কিছু দেশের উপর নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহারের একাধিকবার হুমকি দিয়ে রেখেছে।
প্রায় ৫ দশক ব্যাপী বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল একে অপরের বিরুদ্ধে মোতায়েন করে রাখলেও বাস্তবে তা কখনোই যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়নি। আর এবার সেই প্রচলিত প্রথা ভেঙ্গে গত ২০২৪ সালের শেষের দিকে “ওরেশনিক (RS-26)” আন্তঃমহাদেশীয়/ মিডিয়াম রেঞ্জের ব্যালিস্টিক মিসাইল দিয়ে নজিরবিহীনভাবে ইউক্রেনের উপর হামলা করে। যদিও এতে কোনো ধরনের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ব্যবহার করা হয়নি।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ার সর্বশেষ “ওরেশনিক (RS-26)” আন্তঃমহাদেশীয়/ মিডিয়াম রেঞ্জের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক ব্যবহার সারা বিশ্বের জন্য এক ভয়ংকর বার্তা বহন করে। এটি ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি ICBM ব্যবহারের প্রথম নজির। পাশাপাশি, সম্প্রতি রাশিয়া-আমেরিকার নতুন করে পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার পাল্টাপাল্টি ঘোষণা বিশ্বকে ঠেলে দিচ্ছে এক ভীতিজনক দীর্ঘস্থায়ী “নিউক্লিয়ার কোল্ড ওয়ার”-এর দিকে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, চলতি ২০২৫ সালের হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বের ৯টি দেশের হাতে প্রায় ১২,১১৯টি পারমাণবিক ও থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড মজুদ রয়েছে: রাশিয়া- ৫,৫৮০টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- ৫,০৪৪টি চীন- ৫০০টি ফ্রান্স- ২৯০টি যুক্তরাজ্য- ২২৫টি পাকিস্তান- ১৭০টি ভারত- ১৭২টি ইসরায়েল- ৯০টি উত্তর কোরিয়া- ৫০টি (আনুমানিক)G
১৯৪৫ সালের পর থেকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো দেশগুলো ভূগর্ভে, সাগরতলে এমনকি উন্মুক্ত বায়ুমণ্ডলেও পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই ১৯৪৫–১৯৯২ পর্যন্ত করেছে ১,০৩০টি নিউক্লিয়ার টেস্ট, যেখানে রাশিয়া করেছে ৭১৫টি এবং চীন ৪৫টি। এর পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার নিউক্লিয়ার অস্ত্র পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে।
১৯৯৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে স্বাক্ষরিত কমপ্রিহেনসিভ নিউক্লিয়ার টেস্ট ব্যান ট্রিটি (CTBT)-র উদ্দেশ্য ছিল পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা। কিন্তু আজও যুক্তরাষ্ট্রসহ আটটি দেশ চুক্তিটি অনুমোদন না করায় এটি কার্যকর হয়নি। সেই সুযোগে ২০২৩ সালের নভেম্বরে রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে CTBT থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এতে করে বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নীতিগত প্রতিবন্ধকতা অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়ে।
ইতিহাস সাক্ষী- ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ব্যবহারের পর থেকে বিশ্ব বুঝে গেছে, এ ধরনের অস্ত্র মানবসভ্যতার জন্য কতটা ভয়ংকর। অথচ আজ, ৮০ বছর পরেও, বর্তমানে সেই একই ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ও প্রযুক্তি আবারও বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার, রাজনীতি ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, পরমাণু অস্ত্র কখনোই মানবজাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। বরং এটি ধ্বংস, মৃত্যু ও ভয়াবহ ভবিষ্যতের এক স্থায়ী কালো ছায়া হিসেবে রয়ে গেছে। তবে যাই হোক না কেন, টেকসই বিশ্বশান্তি রক্ষায় সব পরমাণু শক্তিধর দেশকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। কেবল অস্ত্র বানিয়ে কিংবা শত্রুকে ভয় দেখিয়ে কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। এ মুহূর্তে জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ এবং কৌশলগত আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বকে রক্ষা করাই এখন সময়ের দাবি। তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, রয়টার্স, বিবিসি, তাস।
সিরাজুর রহমান,
শিক্ষক ও লেখক।