বড় মেয়ে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করায় ছোট মেয়েকে চার বছর ধরে ঘরে বন্দি করে রাখার অভিযোগ উঠেছে বাবার বিরুদ্ধে। এই দীর্ঘ সময়ে সূর্যের আলো থেকেও বঞ্চিত ছিল সুরজিনা আক্তার জাহান হক লিজা নামের ওই তরুণী। অভিযোগ, তাকে নিয়মিত ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো এবং প্রতিবাদ করলে চালানো হতো শারীরিক নির্যাতন। এর ফলে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।
খবর পেয়ে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পৌর এলাকার হাসপাতাল সংলগ্ন একটি বাড়ি থেকে স্থানীয়দের সহায়তায় লিজাকে উদ্ধার করে পুলিশ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির প্রধান ফটকে তালা ঝুলছিল। বাড়ির মালিক ও লিজার বাবা এনামুল হক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে এলাকাবাসীর তোপের মুখে পড়েন। পরে তিনি তালা খুললে বাড়ির ভেতরের ভয়াবহ চিত্র সামনে আসে। বাড়ির সব জানালা-দরজা বন্ধ এবং সেগুলো যেন খোলা না যায়, তার জন্য টিন ও কাঠ দিয়ে স্থায়ীভাবে আটকে দেওয়া হয়েছে। লিজার ঘরে একটি বাতি ও ছোট ফ্যান ছাড়া আর কিছু নেই। আলো-বাতাসহীন ভুতুড়ে বাড়িটির আসবাবপত্রে "ডা: এনামুল" লেখা। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই এসএসসি পাস করা মেয়েকে দীর্ঘ চার বছর ধরে বন্দি করে রেখেছিলেন তিনি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় পাঁচ বছর আগে অবসরপ্রাপ্ত মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট এনামুল হকের বড় মেয়ে লিমা আক্তার পালিয়ে বিয়ে করেন। এই ঘটনার পর ২০২১ সালে লিজা এসএসসি পাস করলে তার পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছোট মেয়েও পালিয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় তাকে একটি ঘরে বন্দি করে রাখেন বাবা এনামুল। অভিযোগ রয়েছে, লিজাকে প্রায়ই চেতনা নাশক ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো। প্রতিবাদ করলে বাবা ও সৎ মা মিলে তাকে মারধর করতেন। এক পর্যায়ে তার মাথাও ন্যাড়া করে দেওয়া হয়।
প্রতিবেশীরা মেয়েটির কান্নার আওয়াজ পেলেও এনামুলের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। অবশেষে স্থানীয়রা বিষয়টি পুলিশকে জানালে লিজাকে উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
একজন প্রতিবেশী তুহিন বলেন, "লিজা আগে সুস্থ ও স্বাভাবিক একজন মেধাবী ছাত্রী ছিল। বড় বোনের বিয়ের পর থেকেই তার বাবা তাকে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাত। গত চার বছরে আমরা তাকে বাড়ির বাইরে দেখিনি। এক পর্যায়ে সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।"
আরেক প্রতিবেশী সাফসান রাসিক জনি বলেন, "এনামুল সাহেব মেয়েটিকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতেন। মাঝে মাঝে মেয়েটির আর্তনাদ শোনা যেত। আমরা তার বিচার চাই এবং লিজার সঠিক চিকিৎসার দাবি জানাই।"
লিজার সৎ মা ফেরজা বেগম জানান, স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার কথা বলার সাহস ছিল না। এনামুল হক সকালে বাইরে যাওয়ার সময় গেটে তালা দিয়ে যেতেন এবং সন্ধ্যায় ফিরে খুলতেন।
তবে অভিযুক্ত বাবা এনামুল হক তার বিরুদ্ধে ওঠা নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, "বড় মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করে আমার সম্মান নষ্ট করেছে। ছোট মেয়ে লিজা দেখতে সুন্দর হওয়ায় ছেলেরা তাকে বিরক্ত করত। তাই সম্মান বাঁচাতে তার লেখাপড়া বন্ধ করে বাড়িতেই রেখেছিলাম। আমি তাকে নির্যাতন করিনি।"
আক্কেলপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) গণেশ চন্দ্র বলেন, "খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। অস্বাস্থ্যকর ও আবদ্ধ একটি ঘর থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়েছে। দীর্ঘদিন বন্দি থাকায় সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে মুক্ত করে দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য তার বাবাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।"
ডিবিসি/এমএআর