বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া থেকে তাঁর ব্যবহৃত সামগ্রী সরিয়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। কাজী পরিবারের সদস্য এবং চুরুলিয়ার গ্রামবাসীরা এই পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চুরুলিয়ার নজরুল একাডেমীকে অন্ধকারে রেখে কবির স্মৃতিচিহ্নগুলো আসানসোলে অবস্থিত তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সোমবার (৭ই জুলাই) চুরুলিয়ায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে কবির ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী আলি রেজা এই অভিযোগ তোলেন। তিনি জানান, নজরুল ইসলামের জন্মস্থান চুরুলিয়াতে তাঁর ব্যবহৃত বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত আছে। কবির জন্মভিটে, যা ১৯৫৮ সালে নজরুল একাডেমী হিসেবে গড়ে তোলা হয়, তার নিচতলায় একটি সংগ্রহশালা রয়েছে। এই সংগ্রহশালায় কবির হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, প্রথম প্রকাশিত গল্প, কবিতা ও গানের পত্রিকার কপি, তাঁর ব্যবহৃত পোশাক, বাদ্যযন্ত্র, বিভিন্ন সময়ে পাওয়া সম্মাননা, প্রমিলা দেবীর ব্যবহৃত খাট এবং কবির বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র প্রদর্শিত হয়। অভিযোগ উঠেছে, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই মূল্যবান স্মৃতিচিহ্নগুলো আসানসোলে নিয়ে যাচ্ছে।
কাজী আলি রেজা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "শুধু ভারতবর্ষ নয়, এমনকি বাংলাদেশ থেকেও প্রতিবছর বহু মানুষ এই মিউজিয়াম দেখতে আসেন। সকলেরই এই মিউজিয়াম দেখার প্রতি একটা আগ্রহ থাকে। কিন্তু বর্তমানে সেই মিউজিয়ামটিকেই বলা হচ্ছে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে।" তিনি জানান, ইতিমধ্যেই এক ট্রাক ভর্তি সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং আরেকটি ট্রাক ভর্তি সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার সময় তারা বাধা দিয়েছেন। তার দাবি, পূর্বে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সাধন চক্রবর্তীর উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে নজরুল একাডেমী থেকে কোনো জিনিসই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হবে না বরং অন্য জায়গা থেকে কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংগ্রহ করে এই মিউজিয়ামে রাখা হবে।
চুরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দারাও এই ঘটনায় বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন এবং নজরুল একাডেমী কর্তৃপক্ষও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, কোনো অবস্থাতেই এই সমস্ত জিনিস গ্রামের বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
বিতর্ক ওঠার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মিউজিয়ামকে বিশ্বমানের করে তোলার লক্ষ্যেই সেটি সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া হবে। তাই আপাতত মিউজিয়ামে থাকা কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। সংস্কারের কাজ শেষ হলেই তা পুরনো জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
তবে কাজী আলি রেজা আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি জানান, নজরুল মেলা উপলক্ষে কয়েকদিন আগেই আসানসোলের তৃণমূল সাংসদ শত্রুঘ্ন সিনহা কবির বাড়ি সংস্কারের জন্য ১০ লাখ রুপি এবং পাণ্ডবেশ্বরের বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ৫ লাখ রুপি আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেই অর্থ কোথায় গেল বা কী কাজ হয়েছে, সে বিষয়ে তাদের কোনো তথ্য নেই। তিনি অভিযোগ করেন, "জানালা-দরজা ভেঙে পড়ছে, লাইট পাওয়া যায় না, দেওয়ালের রং চাইলে পাওয়া যায় না।"
অন্যদিকে, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার ড. চন্দন কোনার জানান, "নজরুল একাডেমীর এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। নজরুল একাডেমী, কবির বাস্তুভিটে, সংগ্রহশালা সবকিছুই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি।" তিনি আরও বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে চুরুলিয়ায় একটি সংস্কারের কাজ চলছে এবং এর জন্য দেড় কোটি রুপি বরাদ্দ করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের পর্যটন বিভাগ এই প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে কবির ভিটেবাড়ি ও সংগ্রহশালা সংস্কার করা হবে। এই সংস্কারের কথা মাথায় রেখেই সংগ্রহশালায় থাকা কবির পাণ্ডুলিপিসহ অন্যান্য জিনিসপত্র সংরক্ষণ ও সুরক্ষিত রাখার জন্য সেগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আসা হচ্ছে।
ড. কোনা বলেন, "নজরুল কারো ব্যক্তিগত বিষয় নয়। সারা বিশ্বের লোক নজরুলকে নিয়ে কাজ করছেন। আমার মনে হয় কিছু মানুষ কবির পরিচয় দিয়ে এই সব বিষয়গুলি নিজেদের কাছে কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছেন।"
সাংবাদিক সম্মেলনে আলি রেজা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র রেজাউল করিমের মেয়ে এবং নজরুল অ্যাকাডেমির সঙ্গে যুক্ত থাকা সঙ্গীতশিল্পী সোনালি কাজী সহ স্থানীয় বাসিন্দারা। কাজী আলি রেজার আশঙ্কা, কবির মিউজিয়াম থেকে এসব জিনিস বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলে "কবি তীর্থ চুরুলিয়া মানুষের কাছে একটি আবেগ" সেটি অন্ধকার হয়ে যাবে এবং তখন আর কোনো মানুষ এখানে আসবেন না।
ডিবিসি/কেএলডি