বাংলাদেশ, অর্থনীতি

মদে লাভ, চিনিতে লোকসান কেরুর

Faruque

ডিবিসি নিউজ

সোমবার ২৭শে ডিসেম্বর ২০২১ ০১:১৭:১৭ পূর্বাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসএফআইসি) আওতায় পরিচালিত ১৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একমাত্র কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড ছাড়া সবকটি লোকসানে রয়েছে। 

২০২০-২১ অর্থবছরে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড শুধুমাত্র মদ থেকে ১৯৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৩৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বেশি। 

তবে কোম্পানির অন্যান্য বিভাগগুলোতে বড় লোকসান হওয়ায় বছর শেষে সমন্বিত হিসাবে মুনাফা হয়েছে ২৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা বেশি। আর চিনি ইউনিটের লোকসান হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। মূলত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চিনির উৎপাদন না হওয়া এবং উৎপাদন ব্যয় বেশি হলেও কম মূল্যে চিনি বিক্রির ফলে লোকসান হয়েছে।    

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) ১৬টি কোম্পানি পরিচালনা করে যার মধ্যে ১৫টি চিনিকল এবং একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি।

গত বছর, সরকার ছয়টি চিনিকলের উৎপাদন স্থগিত ঘোষণা করে, এবং নয়টি এখনও উৎপাদনে রয়েছে। উৎপাদনে থাকা চিনিকলগুলোর প্রত্যেকটিই লোকসান গুনছে। 

কেরু অ্যান্ড কোং বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি কোম্পানি যা মদ তৈরি এবং বিক্রয় করে। তবে আরো কিছু প্রতিষ্ঠান দেশে আমদানি করা মদ বিক্রি করে থাকে। 

সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাপক অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির কারণে কোম্পানি ব্যয়ের সঙ্গে রাজস্বের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছে না।

অন্যদিকে, অ্যালকোহলের উচ্চ চাহিদা এবং গুণমানের কারণে প্রতি বছর কোম্পানির ডিস্টিলারি বিভাগ থেকে রাজস্বের পরিমাণ বাড়ছে।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের ডেপুটি ম্যানেজার (প্রডাকশন) সাদিকুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শুধুমাত্র কোম্পানির ডিস্টিলারি ইউনিট মুনাফা করে। নানাবিধ কারণে কোম্পানির প্রধান পণ্য, চিনিতে ব্যাপক লোকসান হচ্ছে"।   

তিনি বলেন, "কেরুর উৎপাদিত অ্যালকোহল শুধুমাত্র দেশেই বিক্রি হয়। আমরা তা রপ্তানি করি না। দেশে উৎপাদিত এই  অ্যালকোহল অনেক বিদেশি ব্র্যান্ডের সমমানের, ফলে দিনদিন এর চাহিদা বাড়ছে"।     

৮৩ বছরের মধ্যে মাত্র চার বছরে মুনাফা 

প্রতিষ্ঠার ৮৩ বছরে মাত্র চারবার কেরু অ্যান্ড কোং মুনাফা করতে পেরেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথমবার লাভের মুখ দেখে প্রতিষ্ঠানটি, যা পরবর্তী তিন বছরেও অব্যাহত। 

২০২০-২১ অর্থবছরে এটি ডিস্টিলারি, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ভিনেগার এবং জৈব সার কারখানা থেকে ২৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা লাভ করে। একই সময়ে এটি চিনি এবং খামারে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা লোকসান দেয় । 

এ বছর জৈব সার কারখানা থেকে ২৫ লাখ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার থেকে দেড় কোটি এবং ভিনেগার থেকে ৩২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা আয় হয়। 

২০১৯-২০ অর্থবছরে, কেরু অ্যান্ড কোং ৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা মুনাফা করেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৮ কোটি ২১  লাখ টাকা থেকে যা অধিক।

কেরুর অ্যালকোহল ব্র্যান্ড

আখ থেকে চিনি বের করে নেওয়ার পর যে উপজাত-দ্রব্য পাওয়া যায় তা থেকে কোম্পানিটি অ্যালকোহল এবং বিভিন্ন ধরনের স্পিরিট উৎপাদন করে। 

চিনি উৎপাদনের জন্য আখের রস বের করার পর যে তিনটি উপজাত পাওয়া যায়, তার মধ্যে রয়েছে চিটাগুড়, ব্যাগাস ও প্রেসমাড। এই তিনটি উপজাত-দ্রব্য থেকেই বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হয়।   

মদ বা অ্যালকোহল উৎপাদনের প্রধান উপাদান হল চিটাগুড়। এই গুড় দিয়ে ইস্টকে (খামি) প্রক্রিয়াকরণের পর অ্যালকোহল তৈরি করা হয়।   

কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ডিস্টিলারি ইউনিট কান্ট্রি স্পিরিট, রেকটিফাইড স্পিরিট (অরিজিনাল), রেকটিফাইড স্পিরিট (হোমিও), ডিন্যাচারড স্পিরিট, এবসোল্যুট অ্যালকোহল এবং মদ তৈরি করে থাকে।  

এর মধ্যে মদ থেকেই কোম্পানি সবচেয়ে বেশি লাভ করে। এখানে নয়টি ব্র্যান্ডের ফরেন লিকার বা বিদেশি মদ তৈরি হয়। ফরেন লিকারগুলো হচ্ছে- ইয়েলো লেভেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি, চেরি ব্র্যান্ডি, ইমপেরিয়াল হুইস্কি, অরেঞ্জ ক্রেকাউট, সারিনা ভদকা, রোজা রাম এবং ওল্ড রাম।  

২০২০-২১ অর্থবছরে কোম্পানির ডিস্টিলারি বিভাগ ৫২ লাখ ৪৭ হাজার প্রুফ লিটার মদ উৎপাদন করেছে; বাজারজাত করেছে ৪৬ লাখ ৯৬ হাজার প্রুফ লিটার মদ।  

এছাড়াও ২৮ লাখ ৮৮ হাজার প্রুফ লিটার কান্ট্রি স্পিরিট, ১০ লাখ ৮৮ হাজার প্রুফ লিটার ফরেন লিকার, ৮৮.১০ হাজার প্রুফ লিটার রেকটিফাইড স্পিরিট, ৬.৯১ লাখ প্রুফ লিটার ডিন্যাচারড স্পিরিট এবং ২.৪৮ হাজার প্রুফ লিটার অ্যালকোহল উৎপাদন করেছে কোম্পানি।   

২০২০-২১ অর্থবছরে কেরু অ্যান্ড কোং রেকর্ড পরিমাণ ১.১৬ লাখ কেস বোতলজাত বিদেশি মানের মদ বিক্রি করেছে। মহামারিকালীন সময়ে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানি হ্যান্ড স্যানিটাইজারও উৎপাদন শুরু করে। এই অর্থবছরে, এটি ১.৫ কোটি টাকার ২১,০০০ লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার বাজারজাত করেছে।   

কেরু অ্যান্ড কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার (কৃষি) এবং ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, "প্রতিষ্ঠানটি এখন মুনাফা করছে। কোম্পানির সাথে জড়িত সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এটি সম্ভব হয়েছে। একে সম্পূর্ণ লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার জন্য আমরা বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। যদি মিলটিকে আধুনিকায়ন করা যায়, তাহলে আরো বেশি লাভ করা সম্ভব হবে"। 

কেরু অ্যান্ড কোম্পানির পরিচিতি  

উইকিপিডিয়া অনুসারে, ১৯৩৮ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোক্তাদের অধীনে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি স্থাপিত হয়।  এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান একটি চিনি কল। তবে উপজাত হিসেবে এই কারখানা থেকে মদ উৎপাদিত হয়ে থাকে। 
প্রথমে এর অধীনে একটি চিনি কারখানা, একটি ডিস্টিলারী ইউনিট ও একটি ওষুধ কারখানা যাত্রা শুরু করে। স্বাধীনতা লাভের পর, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে। 

এখানকার মূল পণ্য হচ্ছে আখ থেকে উৎপাদিত চিনি। তবে আখ থেকে চিনি বের করে নেওয়ার পর যে উপজাত দ্রব্য পাওয়া যায় তা থেকেও বিভিন্ন পণ্য উৎপাদিত হয়।

কেরু অ্যান্ড কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ  

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের তথ্যানুযায়ী, ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানির মোট জমির পরিমাণ হচ্ছে ৩০৫৫.৮৪ একর। 

যার মধ্যে আখ আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ২৩৪০ একর। কিছু অংশে অন্যান্য ফসল, বন ও অনাবাদী জায়গা রয়েছে। ঘোলদাড়ি খামারের ১৩৯ একর জমি বেদখল রয়েছে। 

২০২০ সালের জুন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ১১৩৪.৮৭ কোটি টাকার নন-কারেন্ট এসেট এবং কারেন্ট এসেট রয়েছে।  

নন-কারেন্ট এসেটের সম্পদ, উদ্ভিদ যন্ত্রপাতি এবং মূলধনের কাজ চলমান রয়েছে ২০.৮২ কোটি টাকার আর কারেন্ট এসেট রয়েছে ১১১৪.০৪ কোটি টাকার। 

কোম্পানিটির রিজার্ভ আছে ২.০৪ কোটি টাকা; বিভিন্ন ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদী ঋণ রয়েছে ৩৪.৯০ কোটি টাকা।

কেরু অ্যান্ড কোম্পানির পণ্য উৎপাদনের ছয়টি ইউনিট রয়েছে, যা হলো- চিনি, ডিস্টিলারি, ফার্মাসিউটিক্যাল, বাণিজ্যিক খামার, আকন্দবারিয়া ফার্ম (পরীক্ষামূলক) এবং জৈব-সার।

এছাড়া ২০১৪ সাল থেকে নিজস্ব কৃষি খামারে 'কেরুজ জৈব সার' নামে পরীক্ষামূলক জৈব সারের উৎপাদন শুরু হয়। প্রতি কেজি ১০ টাকা দরে এই সার বিক্রয় করে। 

করোনা মহামারির সময় 'কেরুজ স্যানিটাইজার' তৈরী করে বাজারজাত করেছে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। 

২০১৯-২০২০ সালের আর্থিক হিসাব অনুযায়ী, ডিস্টিলারি ও ফার্মাসিউটিক্যাল বিভাগই কেবল মুনাফা করেছে। আর সবগুলো বিভাগেই লোকসান। তবে সবচেয়ে বেশি লোকসান চিনি উৎপাদনে।  

আখ মাড়াই ও উৎপাদন

২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কেরু অ্যান্ড কোম্পানির আখ মাড়াই কার্যক্রম শুরু হয়। কোন যান্ত্রিক সমস্যা ছাড়াই ২০২১ সালের ২১ মার্চ মৌসুমের মাড়াই কার্যক্রম শেষ হয়। 

এই সময়ে ১.১১ লাখ টন আখ মাড়াই করা হয়। আখ মাড়াইয়ের পর চিনি উৎপাদন হয়েছে ৫,৮৮৩ মেট্রিক টন। 

যদিও আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে ১.৫৪ লাখ টন ও ৯,৬২৫ টন। 

এছাড়া ২০১৯-২০ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মিলটির অবিক্রীত চিনির মজুদ ছিল ৪ হাজার ২০০ মেট্রিক টন।      

আরও পড়ুন