দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ‘মেইন ব্যাটল ট্যাংক’(Main Battle Tank বা MBT) কে সাধারণভাবে চারটি প্রজন্মে ভাগ করা হয়। আধুনিক ট্যাংক এখন আর শুধুই একটি সাঁজোয়া যান নয় এগুলো একটি পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ, যা হয়ত যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগত আধিপত্য নিশ্চিত করতে পারে।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অনেক সামরিক বিশ্লেষক মনে করেছিলেন, ড্রোন, স্যাটেলাইট এবং সাইবার অস্ত্রের আধিপত্যে হয়তো ট্যাংকের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টো। প্রযুক্তির অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সামরিক শক্তিধর দেশ চতুর্থ প্রজন্মের ট্যাংক নির্মাণ করে ট্যাংককে আরও আধুনিক, প্রাণঘাতী এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
আজকের এই প্রজন্মের ট্যাংকগুলো শুধু গোলাবারুদ নিক্ষেপ করে না, এগুলো ইন্টেলিজেন্স, সেন্সর সিস্টেম, যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার সক্ষমতা রাখে। চলুন জেনে নেওয়া যাক বিশ্বের কিছু শীর্ষ সামরিক শক্তিধর দেশের তৈরি চতুর্থ প্রজন্মের MBT সম্পর্কে।
জাপানের টাইপ-১০:
২০১২ সালে জাপান তাদের নিজস্ব প্রযুক্তির চতুর্থ প্রজন্মের Type-10 MBT প্রথমবারের মতো প্রকাশ করে। হালকা ওজন, উন্নত সেন্সর এবং নেটওয়ার্ক সেন্ট্রিক যুদ্ধব্যবস্থার সমন্বয়ে গঠিত এই ট্যাংকটি দ্রুত গতিতে চলাচল করতে পারে এবং খুব দ্রুত লক্ষ্য শনাক্ত ও আঘাত হানতে সক্ষম। এতে রয়েছে আধুনিক ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম ও সামরিক যোগাযোগ প্রযুক্তি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ১৪০ থেকে ১৫০ ইউনিট Type-10 জাপান আর্মিতে যুক্ত হবে। প্রতি ইউনিটের আনুমানিক মূল্য ৮.৪ মিলিয়ন ডলার হতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ার K2 ব্ল্যাক প্যান্থার:
২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার তৈরি K2 Black Panther ট্যাংকটি আনুষ্ঠানিকভাবে সার্ভিসে যুক্ত হয়। এতে রয়েছে আধুনিক ১২০ মিমি মেইন গান, স্বয়ংক্রিয় লোডার, উন্নত সাসপেনশন সিস্টেম এবং শক্তিশালী অ্যাক্টিভ প্রোটেকশন সিস্টেম (APS)। এই ট্যাংক স্বয়ংক্রিয়ভাবে শত্রুর হামলা শনাক্ত করে তা প্রতিহত করতে সক্ষম। প্রত্যেকটি ট্যাংকের দাম হবে প্রায় ৮–৯ মিলিয়ন ডলার, এবং ২০২৫ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় ৩৩০টি K2 ট্যাংক উৎপাদন করবে।
রাশিয়ার টি-১৪ আর্মাটা:
২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো উন্মোচিত হয় রাশিয়ার T-14 Armata MBT। এটি বিশ্বের প্রথম ট্যাংক যেখানে পুরো ক্রু একটি সুরক্ষিত ও বর্মযুক্ত ককপিটে অবস্থান করে, যা যুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনে। T-14 ট্যাংকে রয়েছে AI সমর্থিত সেন্সর, উন্নত রাডার ও শক্তিশালী APS। যদিও এটি এখনও সীমিত উৎপাদনের পর্যায়ে রয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে রুশ সেনাবাহিনীতে ২০ থেকে ৩০টির মতো প্রোটোটাইপ ইউনিট যুক্ত হয়েছে।
তুরস্কের আলটাই ট্যাংক:
দক্ষিণ কোরিয়ার কারিগরি সহায়তায় তুরস্ক ২০১০ সালে Altay MBT প্রকল্প শুরু করে। বেশ কিছু বিলম্বের পর ২০২৩ সালে Altay ট্যাংকের প্রথম ব্যাচ সরবরাহ শুরু হয়। উন্নত ফায়ার কন্ট্রোল, সেন্সর এবং প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সংযুক্ত এই ট্যাংকের প্রতি ইউনিটের মূল্য প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার। তুরস্কের লক্ষ্য হচ্ছে ভবিষ্যতে ১,০০০ ইউনিট Altay ট্যাংক তৈরি করা, যা এটিকে বিশ্বের ব্যয়বহুল ট্যাংকগুলোর একটি করে তুলেছে।
চীনের টাইপ-৯৯এ এবং টাইপ-৯৯এ২ ট্যাংক:
চীনের চতুর্থ প্রজন্মের MBT হিসেবে Type-99A এবং উন্নততর সংস্করণ Type-99A2 বর্তমানে PLA (People’s Liberation Army)'র সেবায় যুক্ত রয়েছে। টাইপ-৯৯এ সিরিজের ট্যাংকগুলো চীনের নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত, যা পশ্চিমা ও রুশ ট্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা রাখে। এতে রয়েছে উন্নত কম্পোজিট ও রিঅ্যাক্টিভ আর্মার, স্বয়ংক্রিয় লোডিং সিস্টেম, ১২৫ মিমি স্মুথবোর গান এবং লেজার জ্যামার ও ইনফ্রারেড কাউন্টারমেজারসহ অ্যাডভান্সড সেন্সর ও যুদ্ধাভিজ্ঞতা সমন্বিত কমান্ড সিস্টেম। Type-99A2 মডেলটিতে আরও আধুনিক AI সমর্থিত টার্গেটিং ও অ্যাক্টিভ প্রোটেকশন সিস্টেম যুক্ত করা হয়েছে, যা এটিকে একটি অত্যাধুনিক চতুর্থ প্রজন্মের ট্যাংকে পরিণত করেছে। অনুমান করা হয়, চীন ইতোমধ্যেই কয়েক শতাধিক টাইপ-৯৯ সিরিজের ট্যাংক তাদের সশস্ত্র বাহিনীতে মোতায়েন করেছে।
উত্তর কোরিয়ার নতুন যুদ্ধ ট্যাংক:
২০২০ সালে উত্তর কোরিয়া একটি সামরিক কুচকাওয়াজে বিশ্বের সামনে তাদের নতুন একটি যুদ্ধ ট্যাংক প্রদর্শন করে, যার ডিজাইন অনেকটাই রাশিয়ার T-14 Armata এর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এতে রয়েছে আধুনিক সেন্সর, অটোমেটেড গান সিস্টেম ও শক্তিশালী বর্ম। যদিও এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি, সামরিক বিশ্লেষকদের মতে এটি উত্তর কোরিয়ার তৈরি একটি চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাটল ট্যাংক হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ ট্যাংক কেবল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার প্রতীক নয়, বরং এটি সামরিক কৌশল, প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা এবং ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ড্রোন, স্যাটেলাইট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগেও অত্যাধুনিক ট্যাংক যুদ্ধক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই নতুন প্রজন্মের ট্যাংকগুলো আগামী আরও কয়েক দশক ধরে আধুনিক যুদ্ধের চালিকাশক্তি হয়ে থাকবে।
সিরাজুর রহমান ,লেখক ও শিক্ষক
তথ্যসূত্র: 38 North, The Drive – The War Zone, GlobalSecurity.org, Army Recognition, Wikipedia (Military Technology Sections)