বাংলাদেশ, রাজনীতি

রাজনীতিতে আপসহীন থেকেই চলে গেলেন বেগম খালেদা জিয়া

ডেস্ক প্রতিবেদন

ডিবিসি নিউজ

২ ঘন্টা আগে
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। পাশাপাশি বিএনপির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেজেও এ বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এতে বলা হয়, আজ মঙ্গলবার সকাল ৬টায় তিনি মারা যান।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া  ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি পেয়েছিলেন। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে জীবনের পরম সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।


রাজনীতিকদের জীবনে উত্থান-পতন থাকে। মামলা–মোকদ্দমা, গ্রেপ্তার, কারাবাস, নির্যাতন, প্রতিপক্ষের আক্রমণ- এসবও তাঁদের জীবনে অভাবনীয় নয়। খালেদা জিয়াও চরম পর্যায়ের এমন নির্যাতন সহ্য করেছেন। সহ্য করেছেন স্বামী–সন্তান হারানোর গভীর শোকসন্তাপ, আর দীর্ঘ রোগযন্ত্রণা। রাজনৈতিক জীবনে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব–সংঘাত ছাড়াও প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, লাঞ্ছনা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন খালেদা জিয়া। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলের হয়ে কাজ করে গেছেন। কখনো ছাড়েন নি মাঠ।

 

বেগম খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট, দিনাজপুরে। তাঁর বাবা ইস্কান্দার মজুমদারের বাড়ি ফেনী জেলার পরশুরামের শ্রীপুর গ্রামে। মা তৈয়বা বেগমের জন্ম পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ীতে। তাঁদের তিন মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে খালেদা জিয়া তৃতীয়। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ‘খালেদা খানম’। অত্যন্ত সুন্দর ছিলেন বলে বাড়ির লোকেরা তাঁকে ‘পুতুল’ বলে ডাকতেন। সেটিই তাঁর ডাকনাম হয়ে যায়। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন সেন্ট যোসেফ কনভেন্টে। পরে দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটে (উচ্চমাধ্যমিক) উত্তীর্ণ হন।

 

সেনাবাহিনীর তরুণ ও চৌকস কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট দিনাজপুরের মুদিপাড়ার পৈতৃক বাড়িতে খালেদা খানমের বিয়ে সম্পন্ন হয়। 

 

জিয়া-খালেদা দম্পতির দুই ছেলে। জ্যেষ্ঠ তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর। কনিষ্ঠ আরাফাত রহমান কোকোর জন্ম ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট। কোকো ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে দেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৮১ সালের ৩০মার্চ এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে শহীদ হন।

 

রাজনৈতিক জীবন

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন শুরু। জিয়াউর রহমানের প্রয়াণের পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ১৯৮২ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবন।

 

খালেদা জিয়া রাজনৈতিক জীবনের প্রথম থেকেই দলীয় শৃঙ্খলা ও নেতৃত্ব সমুন্নত রাখার পাশাপাশি এইচ এম এরশাদের স্বৈরশাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনের ভেতর দিয়ে তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রথমেই তিনি দলের শীর্ষপদ পাননি। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ভাইস চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের পর ১৯৮৪ সালে তিনি দলের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি নিজের ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ৪১ বছর দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

 

স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে গঠিত হয়েছিল ৭-দলীয় ঐক্যজোট। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতির কাছে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণ করে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় ‘আপসহীন নেত্রী’  হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি ‘এরশাদ হটাও’ শীর্ষক এক দফা আন্দোলন শুরু করেন। 

 

তাঁর নেতৃত্বে দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামের চড়াই-উতরাইয়ের পথ পেরিয়ে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে অনেকেরই পূর্বানুমান ছিল তাঁর বিরোধী পক্ষই বিজয়ী হবে; কিন্তু সেসব অনুমান মিথ্যায় পর্যবসিত করে দীর্ঘ আট বছরের অবিরাম, নিরলস ও আপসহীন সংগ্রামের পর বিএনপির বিজয় তাঁর নেতৃত্বকে প্রশ্নহীন করে তোলে। দেশের প্রথম ও বেনজির ভুট্টোর পর মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় এবং ২০০১ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

 

খালেদা জিয়া ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মোট ২৩টি সংসদীয় আসনে নির্বাচন করেছেন। কোনোটিতেই তিনি পরাজিত হননি।

 

খালেদা জিয়া জীবনের নানা পর্যায়ে বেশ অনেকটা সময় বন্দিত্বের নির্যাতনের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ২ জুলাই থেকে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত সেনানিবাসে বন্দী ছিলেন। জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর ১৯৮১ সালে সেনানিবাসের বাড়িতে তাঁকে কিছুদিন গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নামে আলোচিত কালপর্বে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মঈনুল সড়কের বাড়িতে গৃহবন্দী করা হয়। পরে সেখান থেকে সংসদ ভবনের একটি বাড়িতে সাবজেল ঘোষণা করে এক বছর সাত দিন তাঁকে বন্দী রাখা হয়।

 

পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত পুরোনো কারাগারে বন্দিত্বের কঠিন সময় কেটেছে খালেদা জিয়ার জীবনে। তাঁর বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে ‘ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা’ করা হয়। গ্রেপ্তার করে এই নির্জন স্থাপনাটিতে বিশেষ কারাগার ঘোষণা করে তাঁকে বন্দী রাখা হয়। এ মামলায় তাঁকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে স্লো পয়জনিংয়ের অভিযোগ ওঠে। উন্নত চিকিৎসার জন্য বারবার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন করেও অনুমতি পাননি। মানবিক কারণে ২০২০ সালে তাঁকে রাজনীতিতে যুক্ত না থাকার শর্তে কারাগার থেকে গৃহবন্দী অবস্থায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। গত বছর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে তাঁর দণ্ড মওকুফ করে মুক্তি দেওয়া হয়।

 

মুক্তি পাওয়ার পর চলতি বছর ৭ জানুয়ারি লন্ডনে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। তাঁর স্বাস্থ্যের অনেকটা উন্নতি হয়েছিল। তবে নানা রোগে জটিলতা ও শরীর-মনে ধকল সহ্য করে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। বয়সও ছিল প্রতিকূল। প্রায়ই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তেন। হাসপাতালে ভর্তি করানো হতো। গত ২৩ নভেম্বর এমনই পর্যায়ে তাঁকে শেষবারের মতো রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এক মাসের কিছু বেশি সময় তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন। এবার তিনি আর চিকিৎসায় সাড়া দিতে পারলেন না। ‘দেশনেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত খালেদা জিয়া চিরবিদায় নিলেন তাঁর প্রিয় দেশবাসীর কাছ থেকে।

 

ডিবিসি/কেএলডি

আরও পড়ুন