বাংলাদেশ, অর্থনীতি, অপরাধ, রাজধানী

রাতের কারওয়ান বাজারে চলছে নীরব চাঁদাবাজি

কাজী শাহরিন হক

ডিবিসি নিউজ

শুক্রবার ২৭শে ডিসেম্বর ২০১৯ ০৫:৪৪:৫৪ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

ফুটপাত যার দখলে তিনিই সেই জায়গার মালিক, আর ফিট মেপে নিতে হয় সেই জায়গা ভাড়া। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে এরকম তিনশ’ দোকান বসে প্রতি রাতে। আর সেখান থেকে প্রতি রাতে তিন থেকে চার লাখ টাকা চাঁদা ওঠে।

তাছাড়া বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও পুলিশকে চাঁদা দিতে হয় মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে। যার প্রভাব পড়ে পণ্যের দামে।

উত্তরের কৃষি প্রধান জেলা লালমিনরহাটে এবার দেড়হাজার হেক্টর জমিতে ফুলকপি চাষ হয়েছে। ভালো ফলন হলেও মিলছে না আশানুরুপ দাম নেই।

একজন সব্জিচাষী বলেন, "পাইকাররা আমাদেরকে ১২-১৪ টাকা রেটে নিয়ে যায়, ওরা বাইরে বেশি রেটে বিক্রি করে।"

আরেকজন চাষী বলেন, "তুলনামূলকভাবে আমাদের যে খরচ হয়েছে সেই পয়সা আমরা পাচ্ছি না।"

এক থেকে দেড় কেজি ওজনের একেকটি ফুলকপি উৎপাদন করতে কৃষকের খরচ হয়েছে আট থেকে দশ টাকা। ব্যাপারীরা তা কিনেছেন বারো থেকে চৌদ্দ টাকা দিয়ে।

একজন ব্যাপারী জানান, ঢাকায় ২২-২৪ টাকা রেটে একেকটি ফুলকপি বিক্রি করেন তারা।

নানা ঘাট হয়ে এই ফুলকপি আসে রাজধানীর পাইকারী মার্কেট কারওয়ান বাজারে। এখান থেকে আবার চলে যায় রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে।

দিনের বেলায় কারওয়ান বাজারের ব্যস্ততার সঙ্গে রাতের ব্যস্ততার আকাশপাতাল ফারাক। প্রতিরাতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত সাত থেকে আটশো ট্রাকে পণ্য আসে এখানে।

জানা গেছে, পার্কিং এর নামে এখানে পাঁচ টনের একেকটি ট্রাক থেকে আদায় করা হতো তিন থেকে পাঁচহাজার টাকা। আর ট্রাক থেকেই সবজি বিক্রি করে দিলে আদায় করা হতো অন্তত দুই হাজার টাকা।

অবশ্য বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নজরে এলে সিটি কর্পোরেশন পার্কিং এর ইজারা বাতিল করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, "একটা কার যদি ঢুকতো তাকে এই চাঁদা আদায়কারীতের সম্মুখে পড়তেই হতো। এই কারওয়ান বাজারের এই জায়গাটিতে তারা অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।  সেই আমি জন্য মেয়র মহোদয়কে বলার পরে মেয়র সেই পার্কিংয়ের ব্যবস্থাটা বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা বাজারটাকেই এখান থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছি।"

পার্কিংয়ের চাঁদা থেকে রেহাই পাওয়া গেলেও বাজারে ঢোকার সময় পণ্য চুরি যাওয়া থেকে বাঁচতে পারেন নি ব্যাপারিরা।

ট্রাক আরো ভেতরে পৌঁছুলে কথা হয় লালমনিরহাট থেকে আসা ব্যাপারী তোরাব আলীর সাথে। তিনি জানান, একেকটা ফুলকপি ১৩ টাকা করে কিনেছেন কৃষকের কাছ থেকে। গাড়ি ভাড়া পড়েছে ২৫ হাজার টাকা।

"এখানে এখন রেট চলছে ২০, ২২, ২৫ টাকা। ১৪ হাজার পিস মাল আসে, ২৫ হাজার টাকা ভাড়া দেই। রাস্তায় সব জায়গায় চাঁদা দিতে হয়।"

গাড়ী চালক জানালেন, অন্যান্য খরচের সাথে মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে দিতে হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা চাঁদা। জানালেন পুলিশকেও দিতে হয় পাঁচশ’ টাকা।

জানা গেছে, যেখানে ট্রাক রেখে মালামাল নামানো হয় ওই ফুটপাতের ভাড়া দিতে হয় এক থেকে দেড়হাজার টাকা।  তাছাড়া রয়েছে শ্রমিকের মজুরি, পরিচ্ছন্নতা কর্মীর টাকা।

এই ফুটপাথ যাদের দখলে তাদের একটি তালিকা তৈরি করেছে ডিবিসি নিউজ।  তাতে দেখা যায়,পুরো কারওয়ান বাজারের ফুটপাথ অন্তত তিনশো ভাগে বিভক্ত। এই ফুটপাথের ভাড়া তোলেন একজন আর তার দখলদার বা মালিকানা আরেকজনের। দখলদারকে মাসোহারা দিয়ে ভাড়া তোলার কাজ করেন তারা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফুটপাথের দখলদারিত্বের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়।

ফুটপাতের তিনশো অংশের মধ্যে তেজগাঁও থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার দখলে রয়েছে ১৮টি, তেজগাঁও থানা ও ওয়ার্ড যুবলীগের দখলে রয়েছে ৩০ টি দোকান,  শ্রমিকলীগের দখলে রয়েছে ৭০ টি, ছাত্রলীগের দখলে রয়েছে ৪৪, শেখ রাসেল শিশুকিশোর পরিষদের নামে রয়েছে পাঁচটি। অন্যান্য দলের মধ্যে জাতীয় পার্টির নেতাদের দখলে ১০টি, বিএনপি নেতাদের দখলে ২০টি, যুবদলের দখলে ১০টি, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাদের নামে ১০টি এবং অন্যান্য প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে ১৩টি।

এর বাইরেও রয়েছে বিচ্ছিন্ন চাঁদাবাজি।

কারওয়ান বাজারের হোটেল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, "আমার কাছে চাঁদা চাইছে এক লাখ টাকা। আমি টাকা দেই নাই দেখে আমার ছোট ভাইকে মারধর করেছে। দুই মাস আমাকে দোকানে আসতে দেয় নাই। আমাকে বলা হয়েছে, তুই দোকানে আসলে তোকে টাকা দিতে হবে, টাকা না দিলে তোকে গুলি করে মেরে ফেলব।"

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফুটপাত অন্যদের দখলে থাকায় মালামাল আড়তে কিংবা দোকানে নিতে অসুবিধা হয়। তাই মার্কেটে দোকান থাকার পরও বাইরের ফুটপাথ ভাড়া নিতে হয় ওইসব দখলদারের কাছ থেকে। ফুটপাতের জন্য প্রতিদিনের ভাড়া ছাড়াও দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা এককালীন দিতে হয় দখলদারদের।

একজন ব্যবসায়ী ডিবিসি নিউজকে বলেন, "সিটি করপোরেশানের অনুমোদিত ভাড়া চালাচ্ছি আর কি, মালিক থেকে নিয়ে। বাইরে জায়গা ভাড়া নিসি। ওয়াসার রোডে একটা ঘর দিবে বলছিলো কানা জসীম, মানে জসীম পাটোয়ারী, টাকা নিয়েছিলো দুই লাখ, কিন্তু কোনো ঘর দেয় নাই।"

কিন্ত কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ ওমন ফারুক বলেন, "ব্যাপারী এখন চিন্তা করে যে ওনার ঘরে মাল নেয়া পর্যন্ত দুই ঘণ্টা লাগবে, সেই দুই ঘণ্টায় মাল রাস্তায় নামায়ে বেচে চলে যেতে পারবে।"

তবে পুলিশ বলছে, মানবিক কারণে ফুটপাত উচ্ছেদ করা হয়নি।  আর বিচ্ছিন্ন চাঁদাবাজি রুখতে কারওয়ান বাজারে একটি পুলিশ ফাঁড়ি করা হচ্ছে।

তেজগাঁও জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, "যারা ফুটপাথে ব্যবসা করছে, তারা তো এই ব্যবসা করেই যে উপার্জন হয় তাতেই তাদের সংসার চলে। আমরা যদি এদের হঠাৎ করে উঠিয়ে দেই তাহলে তাদের সংসার চলবে কেমন করে? এদেরকে উঠিয়ে দিলে আরেকটা সামাজিক সমস্যা দেখা দিবে যে, দেখা যাবে তারা জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য চুরি-ছিনতাই এসবে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।"

তিনি আরো বলেন, "এখানে একটা ফাঁড়ি স্থাপন করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।"

তেজগাঁও জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদ খান বলেন, "২৪ ঘণ্টা মনিটর করা হবে। পুরো কারওয়ান বাজার সিসিটিভি নেটওয়ারর্কের আওতায় চলে আসবে যাতে করে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না হয়।"

সবমিলিয়ে কৃষকের কাছ থেকে কারওয়ান বাজার আড়তে ফুলকপি পৌছাতে খরচ পড়ে চার থেকে পাঁচ টাকা। যে ফুলকপি মাঠ থেকে কৃষক ১৩/১৪ টাকায় বিক্রি করেছেন, তা আড়ত থেকে ব্যবসায়ীরা খুচরা বিক্রেতার কাছে ২২/২৩ টাকায় বিক্রি করেন।

বিভিন্ন বাজারের খুচরা বিক্রেতারা আড়ত থেকে মালামাল কিনে ফুটপাতের একটি জায়গায় রাখেন। তাদেরও দিতে হয় সেই জায়গার ভাড়া।

একজন ব্যবসায়ী বলেন, "মাল অনুযায়ী টাকা দিতে হয়। মাল কম হলে কম, বেশি হলে বেশি।"

তারপর ভ্যানে করে খুচরা বাজারে নিয়ে যান তারা। খুচরা বাজারে ২২ থেকে ২৩ টাকা কেনা ফুলকপি বিক্রি করা হয় ৪০ টাকায়। অর্থাৎ ফুলকপি প্রতি কৃষক পাচ্ছেন ১৩/১৪ টাকা আর খুচরা বাজারে তা ক্রেতারা কিনছেন ৪০ টাকায়।

সড়কে এবং কারওয়ান বাজারের চাঁদাবাজি বন্ধ হলে পণ্যের দাম আরো কমে আসবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

আরও পড়ুন