এয়ারলাইন্স বন্ধ হওয়ার মিছিল যত দীর্ঘ হবে বাংলাদেশের এভিয়েশন তত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাতীয় বিমান সংস্থা ছাড়া বেসরকারী বিমান সংস্থার মধ্যে গত ২৮ বছরে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে হয়ে গেছে- যা খুবই দুঃখজনক। এর মধ্যে দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চষে বেড়ানো জিএমজি এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ, বেস্ট এয়ার উল্লেখযোগ্য।
বর্তমানে চালুকৃত তিনটি বেসরকারী এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা, নভো এয়ার, এয়ার অ্যাস্ট্রা। স্রোতের বিপরীতে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ইউএস-বাংলা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত। নব প্রতিষ্ঠিত এয়ার অ্যাস্ট্রা প্রায় দুই বছরের অধিক সময় পার করলেও সঠিক গন্তব্যে এখনো যেতে পারেনি। আরেকটি এয়ারলাইন্স নভো এয়ার নানা গুঞ্জনের ডালপালা ছড়ালেও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন সময় আমার বিভিন্ন বক্তব্যে, বিভিন্ন লেখনীতে বলার চেষ্টা করেছি- বাংলাদেশের এভিয়েশনে দশ বছরের সময়কালটা যেকোনো এয়ারলাইন্সের জন্য অশনি সংকেত না শুভ সংকেত ! যেসব এয়ারলাইন্স দশ বছরের মাইলস্টোনটা ঠিক মতো অতিক্রম করতে পারেনি তাদের জন্যই বাংলাদেশে আকাশ পরিবহনের ব্যবসাটা হয়ে আসছে অশনি সংকেত হয়ে।
সাধারণ জনগন হয়তো একদিন ঘুম ভেঙ্গে খবরের পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে দেখবে একটি খবর, যা শিরোনাম হয়ে ভেসে আসবে কিংবা টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলের জন্য ব্রেকিং নিউজ কিংবা দিনব্যাপী স্ক্রলে চলমান থাকবে দেশের আরেকটি এয়ারলাইন্সের অপারেশন বন্ধ। খারাপ লাগবে, মন খারাপ হবে। কিন্তু চরম বাস্তবতা হচ্ছে একটি এয়ারলাইন্সের এই ধরনের শিরোনাম হওয়ার পূর্বে অতিক্রান্ত প্রায় দুই বছরের সময়কালটা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বন্ধ হওয়া এয়ারলাইন্সগুলোর ইতিহাস প্রায় একই রকম। নানা রকম সংকেত পাওয়ার পরও ব্যবসায় সিরিয়াস হওয়ার লক্ষণ দেখা যায়নি।
একজন এভিয়েশন জনসংযোগবিধ হওয়ার কারনে বাংলাদেশ এভিয়েশনের উন্থান-পতন খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, যার উপর ভিত্তি করে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করছি। আকাশ পরিবহন ব্যবসায় একটি নতুন এয়ারলাইন্সের আগমনের জন্য প্রায় দু’বছরের ক্ষণ গননা করতে হয় প্রতিটি এয়ারলাইন্সকে। ঠিক বিপরীত চিত্রও দেখতে পাওয়া যায়, একটি প্রতিষ্ঠিত এয়ারলাইন্সও বন্ধ হওয়ার মিছিলে শরিক হতে দু’বছরের কার্যক্রম ফলো করলেও প্রায় সবার একই রকম চিত্র দেখা যায়।
বিগত দিনের বন্ধ হওয়া এয়ারলাইন্সগুলোর কিছু নির্দিষ্ট চরিত্র দেখতে পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রেগুলেটরী অথরিটির কাছে দেনা হিসেবে বিভিন্ন চার্জ প্রদান না করার অভ্যাস। কারন বন্ধ হওয়া এয়ারলাইন্স থেকে এখন পর্যন্ত বাকী টাকা উদ্ধারের নজির দেখা না পাওয়া। বন্ধ হওয়ার পূর্বে খরচ কমানোকে উপলক্ষ ধরে কর্মচারী-কর্মকর্তা ছাটাই যেন নিয়মিত ঘটনা।
এয়ারলাইন্সগুলো থেকে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাওনা না দেয়ার প্রবণতা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রদেয় সুবিধাদি বন্ধ করা।
এয়ারলাইন্সগুলোর এয়ারক্রাফটগুলো নির্দিষ্ট সময়ে হেভী চেক বিশেষ করে সি-চেক, ডি চেকের মতো চেকগুলো নিয়মিত না করা। গ্রাউন্ডেড এয়ারক্রাফটকে সচল না রাখার প্রবনতাও দেখা যায়। এয়ারক্রাফটের মতো রুট চয়েসেও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে দেখা যায় এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে। যাত্রী স্বল্পতার অজুহাত তুলে প্রতিনিয়ত সিডিউল ফ্লাইট বাতিল করতে দেখা যায়। ব্র্যান্ড ইমেজ রক্ষায় যাত্রী ও এজেন্সিদের ম্যানেজ করার জন্য ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ করার পূর্বে বিভিন্ন ধরনের প্রতিজ্ঞা করা। যাতে এয়ারলাইন্সগুলোকে পুনরায় ব্যবসায় ফিরিয়ে আনা সহজতর হয় কিন্তু বাস্তবে বিগত দিনে বন্ধ হওয়া একটি এয়ারলাইন্সেরও পুনর্জন্ম ঘটতে দেখিনি।
বন্ধের অপেক্ষায় থাকা এয়ারলাইন্সগুলো যেমন কর্মচারী ছাটাই করতে থাকে তেমনি নিজস্ব সেলস অফিসগুলো বন্ধ করার জন্য তৎপর থাকে। প্যাসেঞ্জার গ্রোথের সাথে সাথে বিজনেস গ্রোথ যখন কমতে থাকে তখন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নতুন করে বিনিয়োগের পরিকল্পনা থেকে দূরে সরতে থাকে। যা একটা সময় একটি স্বপ্নের পতন ঘটে। একটি স্বপ্নসারথির সমাধি হিসেবে একটি অপারেশনাল এয়ারলাইন্সের যবনিকাপাত ঘটে।
লেখক:
মোঃ কামরুল ইসলাম
মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স