বিশ্বের প্রধান সামরিক শক্তিধর এবং প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাইপারসনিক ওয়েপন্স/ মিসাইল প্রযুক্তি নিয়ে শুরু হয়েছে এক তীব্র মাত্রার প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতায় মাত্র ৬টি দেশ তাদের সাফল্যের দাবি করে থাকে। যার মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, চীন, আমেরিকা, ইরান, ভারত এবং উত্তর কোরিয়ার মতো দেশ। হাইপারসনিক গতির সিস্টেম বলতে এমন এক এরিয়াল বা অস্ত্র ব্যবস্থাকে বোঝায়, যা ম্যাক ৫ এর বেশি গতি অর্জন করতে সক্ষম অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৬,১৭৪ কিলোমিটার বা তারও বেশি হতে পারে।
এরিয়াল সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য হলো শুধু উচ্চ গতি নয়, বরং ফ্লাইট চলাকালে গতি ও দিক পরিবর্তনের সক্ষমতা। যার ফলে প্রচলিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা এগুলো শনাক্ত এবং প্রতিহত করাটা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এই প্রযুক্তিকে সাধারণত তিনটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল (এইচজিভি), হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইল (এইচসিএম) এবং হাইপারসনিক অ্যারো-ব্যালিস্টিক মিসাইল। প্রতিটি ধরনের আবার নিজস্ব কিছু কৌশলগত সুবিধা রয়েছে। যা খুবই অল্প সময়ে এবং দ্রুত গতিতে টার্গেটে আঘাত করার সক্ষমতা প্রদান করে।
গত (২৫শে এপ্রিল) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর 'পেন্টাগন' জানায় যে, ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল স্পেস ফোর্স স্টেশন থেকে "ডার্ক ঈগল" নামে পরিচিত লং-রেঞ্জ হাইপারসনিক ওয়েপন (LRHW) সিস্টেমের সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। এটি ছিল আসলে গত ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের সফলতার পর দেশটির দ্বিতীয় সফল পরীক্ষা। ৭.৪ টন ওজনের 'ডার্ক ঈগল' নামের এই হাইপারসনিক গতির মিসাইলটির সর্বোচ্চ গতি হচ্ছে ম্যাক ৫ (প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৬,১৭৪ কিলোমিটার) এবং এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ প্রায় ২,৭৭৬ কিলোমিটার।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর 'পেন্টাগন' ফ্লোরিডার স্পেস লঞ্চ কমপ্লেক্স-৪৬ থেকে উৎক্ষেপণের মাধ্যমে এই হাইপারসনিক ওয়েপন্স/ মিসাইলটির বাস্তব প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও অবিশ্বাস্য গতির বিষয়টি নিবিড়ভাবে যাচাই করে। আমেরিকার লকহিড মার্টিন কর্পোরেশন এই উচ্চপ্রযুক্তির সারফেস-টু-সারফেস বুস্ট-গ্লাইড হাইপারসনিক ওয়েপন ডিজাইন ও নির্মাণ করেছে এবং এর প্রধান ব্যবহারকারী হচ্ছে ইউএস আর্মি। এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করেছে, রাশিয়া ও চীনের পাশাপাশি তারাও হাইপারসনিক প্রযুক্তির দৌড়ে অনেকটাই শক্ত অবস্থানে রয়েছে।
তাছাড়া গত ২০২৩-২৪ সালের দিকে আমেরিকার এয়ার-লঞ্চড AGM-183A হাইপারসনিক মিসাইল (এক হাজার মাইল রেঞ্জ) সফলভাবে বি-৫২ হেভি স্ট্র্যাটেজিক বোম্বার এয়ারক্রাফট থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়, তার আগে অবশ্য দেশটি এই সিস্টেম পরীক্ষাটিতে মোট আটবার ব্যর্থ হয়েছিল। এদিকে হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরি ও গবেষণায় 'পেন্টাগন' চলতি ২০২৫ অর্থবছরে ৬.৯ বিলিয়ন ডলার অনুরোধ করে। যা হবে কিনা গত ২০২৩ অর্থবছরের ৪.৭ বিলিয়ন ডলার থেকে অনেকটাই বেশি।
একবিংশ শতাব্দীর এই নতুন অভাবনীয় উচ্চ গতির হাইপারসনিক টেকনোলজিতে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া এবং ভারতের মতো দেশ এগিয়ে থাকলেও বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে সফলতার নিরিখে এখনো পর্যন্ত রাশিয়াই একমাত্র দেশ, যারা কিনা গত ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইউক্রেনের একাধিক টার্গেটে আনুমানিক শতাধিকের উপর বিভিন্ন সিরিজের হাইপারসনিক মিসাইল সিস্টেম ব্যবহার করে সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তবে এটিকে এখনও পর্যন্ত গেম চ্যেঞ্জার ওয়েপন্স বলার মতো সময় আসেনি।
বর্তমানে রাশিয়া মূলত তিনটি সিরিজের হাইপারসনিক মিসাইল বিশ্বের সামনে উন্মোচন করেছে। যার মধ্যে এয়ার লঞ্চড বেসড 'কিনঝাল' (KH-47M2 Kinzhal) সর্বোচ্চ গতি ম্যাক ১০ (প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১২,৩০০ কিলোমিটার) এবং সর্বোচ্চ রেঞ্জ প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার। অন্যদিকে সাবমেরিন এবং যুদ্ধজাহাজ ভিত্তিক ১ হাজার কিলোমিটার রেঞ্জের স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনচালিত 'জিরকন' (3M22 Zircon) হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইলের সর্বোচ্চ গতি ম্যাক ৯ (প্রায় ১১,০২৫ কিলোমিটার/ঘণ্টা)।
এর পাশাপাশি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি স্বল্প পাল্লার ট্যাকটিক্যাল ইস্কান্দার (Iskander-M) সিরিজের হাইপারসনিক মিসাইল ব্যবহার করে। নিউক্লিয়ার/কনভেনশনাল ওয়ারহেড ক্যাপাবল ৫০০ কিলোমিটার রেঞ্জের ল্যান্ড বেসড এই (9K720) মিসাইলের সর্বোচ্চ গতি ম্যাক ৬ থেকে ৭ বা প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৭,৪০৮.৮ কিলোমিটার। তবে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর তরফে জানানো হয়, তারা ইতোমধ্যেই প্রায় অর্ধ শতাধিক এই জাতীয় ইস্কান্দার-এম হাইপারসনিক মিসাইল তাদের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম দ্বারা আকাশেই ধ্বংস বা ইন্টারসেপ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।
বৈশ্বিক পর্যায়ে হাইপারসনিক টেকনোলজির প্রতিযোগিতায় রাশিয়া এবং আমেরিকার পাশাপাশি অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে রেড জায়ান্ট চীন। দেশটি তাদের নিজস্ব উচ্চ প্রযুক্তির বেশকিছু সিরিজের হাইপারসনিক মিসাইল সিস্টেম ডিজাইন ও তৈরি করেছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এয়ার লঞ্চড বেসড ডিএফ/কেএফ-২১ (CH-AS-X-13) হাইপারসনিক ব্যালেস্টিক মিসাইল। ৩ হাজার কিলোমিটার রেঞ্জের এই নতুন প্রজন্মের মিসাইলের গতি ম্যাক ১০.০ বা প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১২,৩৪৮ কিলোমিটার।
ডিএফ/কেএফ-২১ হাইপারসনিক মিসাইলের পাশাপাশি চীন বিশ্বের সামনে উন্মোচন করে আরেকটি শক্তিশালী এবং উচ্চ প্রযুক্তির ডিএফ-১৭ মিসাইল। এই জাতীয় হাইপারসনিক মিসাইল সিস্টেম গ্রাভিটি-অ্যাসিস্টেড গ্লাইড প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চগতি অর্জন করে। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তথ্যমতে, র্যামজেট বা স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিন প্রযুক্তি নির্ভর ডিএফ-১৭ গ্লাইড প্রযুক্তির হাইপারসনিক মিসাইল সিস্টেমের রেঞ্জ হতে পারে ১,৮০০ কিলোমিটার থেকে ২,৫০০ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ গতি প্রায় ম্যাক ৫ বা তার অধিক হতে পারে।
এদিকে হাইপারসনিক ওয়েপন্স সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভারত নিজস্ব প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে এগিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশেষ করে কিছুদিন ভারতের ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (DRDO) স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনচালিত নতুন প্রজন্মের হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল (HGV) এর সফল পরীক্ষা চালায়। এর সর্বোচ্চ গতি ছিল ম্যাক ৬ (প্রায় ৭,৪০৮ কিলোমিটার/ঘণ্টা)। আর DRDO এর DRDL ল্যাব প্রায় ১ হাজার সেকেন্ড ব্যাপী সফলভাবে Active Cooled Scramjet Combustor গ্রাউন্ড টেস্ট করে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে।
এদিকে হাইপারসনিক প্রযুক্তিতে ইরান এবং উত্তর কোরিয়া সফলতা দাবি করে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তির হাইপারসনিক মিসাইল টেস্টের বিষয়টি বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে। মনে করা হয় রাশিয়ার প্রযুক্তিগত সহায়তায় ইরান খুব সম্ভবত বেশকিছু সিরিজের হাইপারসনিক মিসাইল ডিজাইন ও তৈরি করেছে। সম্প্রতি ইরান দাবি করেছে যে, তারা 'ফাত্তাহ' সিরিজের ১,৪০০ কিলোমিটার রেঞ্জের হাইপারসনিক মিসাইল তৈরি এবং পরীক্ষা করেছে। যার গতি হতে পারে অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাক ১৪ (প্রায় ১৫,০০০ কিলোমিটার/ঘণ্টা)।
যদিও ২০২২ সাল থেকে হাইপারসনিক মিসাইল প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্বজুড়ে তীব্র আগ্রহ ও আলোচনা শুরু হয়েছে, বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা নিয়ে এখনো সামরিক বিশ্লেষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়ে গেছে। কেউ কেউ একে 'গেম চেঞ্জার' অস্ত্র বললেও, এখনো এটি প্রচলিত যুদ্ধনীতিতে পরিপূর্ণভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তবে আগামী এক দশকের মধ্যে হয়ত হাইপারসনিক প্রযুক্তির ব্যাপক আধুনিকায়ন এবং উন্নয়ন বৈশ্বিক পর্যায়ে সামরিক কৌশলের মানচিত্র আমূল পাল্টে দিতে পারে।
ডিবিসি/নাসিফ