বুধবার (৩রা সেপ্টেম্বর) চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি জাপানের বিরুদ্ধে বিজয় দিবসের ৮০তম (ভি-ডে) বার্ষিকী উপলক্ষে এক মহড়ায় তাদের অস্ত্র ভান্ডারে থাকা কৌশলগত ও ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার মিসাইলসহ আধুনিক প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে।
এই প্যারেডে চীন তাদের আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল (ICBM), হাইপারসনিক মিসাইল, উন্নতমানের কমব্যাট ড্রোন, ষষ্ঠ প্রজন্মের কনসেপ্ট (প্রোটোটাইপ) এয়ারক্রাফট এবং লেজার অস্ত্রসহ নতুন প্রজন্মের বিপুল পরিমাণ ডিফেন্স সিস্টেম প্রদর্শন করে।
আন্তর্জাতিক সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, আজকের ৮০তম বিজয় দিবসে চীনের সামরিক প্যারেড এবং অস্ত্র প্রদর্শন ছিল মূলত বিশ্বের কাছে চীনের একটি নতুন কৌশলগত বার্তা। যেখানে দেশটি নিজেদেরকে একবিংশ শতাব্দীর এক অভাবনীয় সামরিক সুপারপাওয়ার হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে গেছে।
এই প্যারেডে চীন হাইপারসনিক এবং লেজার ওয়েপন্স এর পাশাপাশি তাদের অস্ত্র ভান্ডারে থাকা সবচেয়ে উন্নত ও শক্তিশালী কৌশলগত অস্ত্র ডংফেং-৪১ (DF-41) আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রদর্শন করে। ১২–১৫ হাজার কিলোমিটার পাল্লার এই মিসাইলটি ৮–১০টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড (MIRV) বহন করতে পারে।
প্রায় ৮০ টন ওজনের ডিএফ-৪১ (আইসিবিএম) মিসাইল সাইলো ও মোবাইল (TEL) উভয় প্ল্যাটফর্ম থেকেই খুব দ্রুত নিক্ষেপ করা যায়। সলিড ফুয়েল মোটর চালিত এই কৌশলগত মিসাইলটিকে বর্তমানে চীনের “স্ট্র্যাটেজিক নিউক্লিফুয়ার ট্রায়াড”-এর প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
যদিও বাস্তবে চীন তাদের অস্ত্রভাণ্ডারের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য প্রকাশ করে না। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামরিক থিংক ট্যাংকের হিসাব অনুযায়ী তাদের হাতে বর্তমানে কয়েকশ (ICBM) ছাড়াও হয়ত প্রায় কয়েক হাজারের অধিক বিপুল সংখ্যক ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের মিসাইল মজুত থাকতে পারে।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের ২০২৩ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীনের কাছে বর্তমানে ৫০০–৬০০টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড রয়েছে, যা কিনা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে হয়ত ১ হাজারের সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। যদিও এটি হচ্ছে একটি অনুমান নির্ভর তথ্য। তবে বাস্তবে হয়ত এ মুহুর্তে চীনের গোপন অস্ত্র ভান্ডারে হয়ত বিপুল পরিমাণ নিউক্লিয়ার অস্ত্রের বিশাল মজুত গড়ে উঠেছে।
তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন তার সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাজেট ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করেছে। গত ২০২৪ সালে দেশটির আনুষ্ঠানিক প্ররক্ষা বাজেট ছিল ২৩১.৩৬ বিলিয়ন ডলার, তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দাবি করে, চীনের এ খাতে প্রকৃত ব্যয় প্রায় ৪৩৯ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে।
এর পাশাপাশি চলতি ২০২৫ সালে চীনের মোট সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাজেট আরও বৃদ্ধি পেয়ে ২৫০-৩০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে বলে ধারণা করা হয়। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ মূলত নিউক্লিয়ার ফোর্স, স্ট্র্যাটেজিক মিসাইল উন্নয়ন এবং নতুন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির গবেষণায় ব্যয় করা হচ্ছে। শুধু গবেষণা ও উন্নয়ন খাতেই এখন চীন প্রতিবছর আনুমানিক ১৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে।
আসলে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য পুনর্গঠনের লক্ষ্যে চীন অভূতপূর্ব গতিতে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। বিশেষ করে নিজস্ব প্রযুক্তির উন্নত ও নতুন প্রজন্মের সামরিক সাজ সরঞ্জাম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর কেড়েছে। আর তাই ২০২৫ সালের এই বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত নতুন প্রজন্মের এসব অস্ত্রশস্ত্র ছিল সেই ধারাবাহিক কৌশলেরই একটি অংশ মাত্র।
আন্তর্জাতিক সামরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের চলমান এ ধরনের সামরিক অগ্রযাত্রা ও উন্নয়ন আগামী দুই দশকের মধ্যে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যেই চীন হয়ত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হওয়ার পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক সুপারপাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। তথ্যসূত্র: SIPRI, Wikipedia, Pentagon report, Global Firepower
সিরাজুর রহমান, শিক্ষক ও লেখক
ডিবিসি/ এইচএপি