বাংলাদেশ, লাইফস্টাইল

‘চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও’

ডেস্ক রিপোর্ট

ডিবিসি নিউজ

শুক্রবার ১লা সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:২০:৩৮ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

‘ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’ গানটি লিখতে গিয়ে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কি ভেবেছিলেন মানুষ একসময় শুধুই আকাশের ঠিকানায় অর্থাৎ অন্তর্জালে (ইমেইলে) চিঠি লিখবে! বাস্তবতা এই এখন দাপ্তরিক কাজের নথি বা আবেদনপত্রের ঝক্কি ছাড়া কেউ ডাকঘরে যায় না। অথচ একসময় দূরে থাকা আপনজনের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। এমনকি অন্তরের খুব কাছের কাউকে মুখে না বলতে পারা কথাগুলোও সযত্নে সাজিয়ে নেওয়া হতো চিঠিতে।

মোবাইল ফোন-ইমেইল যুগের আগে চিঠিই ছিল যোগাযোগের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম। টেলিফোন আবিষ্কৃত হলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ মানুষ যোগাযোগের জন্য চিঠির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। চিঠি লিখে খামে ভরে নির্দিষ্ট ডাকবাক্সে ফেলতে হতো। এখনও রাস্তার মোড়ে মোড়ে নির্দিষ্ট জায়গায় অব্যবহারে জীর্ণ, ধূলি ধূসরিত ডাকবাক্স চোখে পড়ে।

চিঠির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল নানা স্মৃতি, নানা আবেগ। চিঠি লেখার আবেগ বর্তমানের ম্যাসেঞ্জারের টেক্সট কিংবা ইমেইলে পাওয়া যায় না। আগে একেকটি চিঠি যেন হয়ে উঠত একেকজনের জীবনে প্রাণের সঞ্চার।

শুধু প্রেম নয়, সব ধরনের যোগাযোগ হতো চিঠির মাধ্যমে। কোনো এক বেকারের চাকরির খবর, বিদেশে থাকা ছেলের মায়ের কাছে চিঠি কিংবা দেশ হতে বিদেশে ছেলের জন্য মায়ের লেখা চিঠি। শুধু দূরে কিংবা অদেখা মানুষকেই মানুষ চিঠি লিখত না, যার সাথে প্রায়ই দেখা হয় কিংবা প্রতিদিন দেখা করা প্রেমিক প্রেমিকাও একে অপরকে চিঠি লিখত। শুভেচ্ছা বার্তা, খোঁজ-খবর নেওয়া, টাকা পাঠানো, চাকরির যোগদানপত্র সবই এক সময় আসত চিঠির মাধ্যমে।

মহাদেব সাহার কবিতার মতো করে কত প্রেমিকই তো তার প্রিয়তমার কাছে চিঠি চাইতেন।
‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।’

সাধারণত তিনটি ডাকবাক্স একসঙ্গে দেখা যায়। তিনটি ডাকবাক্সের রঙ তিন ধরনের। লাল, নীল, হলুদ। চিঠি লিখে এই ডাকবাক্সগুলোতে ফেললে ডাকপিয়ন চিঠি সংগ্রহ করে পোস্ট অফিসে নিয়ে যেতেন। সেখান থেকে নির্দিষ্ট ঠিকানায় চিঠিগুলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এই নির্দিষ্ট ঠিকানায় পাঠানোর সুবিধার্থেই তিনরঙা ডাকবাক্সের প্রচলন শুরু হয়। নীল ডাকবাক্সে বিদেশে পাঠানোর চিঠি, লাল ডাকবাক্সে দেশের মধ্যে অন্য অঞ্চলের চিঠি এবং হলুদ ডাকবাক্সে ফেলতে হতো একই শহরের ঠিকানার চিঠি। বিদেশে পাঠানো চিঠি উড়োজাহাজে পরিবহন করে নির্দিষ্ট দেশে পৌঁছে দেওয়া হতো।

‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে। রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে, রানার রানার চলেছে, রানার’- সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতার সেই রানার আজ নেই। আগের মতো আর বাড়িগুলোর গেটে দেখা মেলে না চিঠির বাক্সের। প্রেয়সীর কাছে সুগন্ধী মেখে চিঠি লিখত প্রেমিক, এমন কথা অনেকেই হয়ত শুনেছেন। এখন আর সেসব নেই। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এখন যোগাযোগের অন্যতম ভরসা মোবাইল ফোন। ফেসবুক, টুইটার, মেসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ফলে চিঠি হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য। ডাক বিভাগে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও গত ৫ বছরে ডাক বিভাগের চিঠি কমেছে অর্ধেক।

রাজশাহী ডাক বিভাগের তথ্য মতে, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে উত্তরাঞ্চলের চিঠি ও অন্যান্য পার্সেল হয়েছে চার লাখ ২৭ হাজার ৭৩৬টি। এসব থেকে ডাক বিভাগের আয় হয় ৩৪ লাখ ৪৩ হাজার ১২৬ টাকা। এর মধ্যে সাধারণ চিঠি দুই লাখ ৫৭ হাজার ২৩৬টি। বিদেশে থেকে সাধারণ চিঠি আসে ৬৯৫টি। রেজিস্ট্রি চিঠি হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯৪টি। বিদেশ থেকে এসেছে ২২৩টি। পার্সেল এসেছে আট হাজার ৪০৫টি। বিদেশ থেকে এসেছে দুটি। জিইপি হয়েছে চার লাখ ছয় হাজার ২১টি ও ইএমএস হয়েছে ১৬০টি।

আর ২০২৩ সালের জুলাইয়ে উত্তরাঞ্চলের চিঠি ও অন্যান্য পার্সেল হয়েছে দুই লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৫টি। এসব থেকে আয় হয়েছে ২৫ লাখ ৪২ হাজার ১৪৬ টাকা। এর মধ্যে সাধারণ চিঠি এসেছে ৯৯ হাজার ২৪৯টি। বিদেশে থেকে সাধারণ চিঠি এসেছে ৪০টি। রেজিস্ট্রি চিঠি হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৬৫০টি। বিদেশ থেকে এসেছে ৩৯টি। পার্সেল এসেছে তিন হাজার ৮৯৩টি। বিদেশ থেকে এসেছে ছয়টি। জিইপি হয়েছে তিন লাখ ৬৮১টি ও ইএমএস হয়েছে ২৬২টি।

গত ৫ বছরে ডাক বিভাগের চিঠি কমেছে এক লাখ ৮২ হাজার ৯০১টি। আয় কমেছে ৯ লাখ ৯৮০ টাকা।

রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পোস্টমাস্টার জেনারেল শেখ সাইফুল আলম বলেন, ‘চিঠির সংখ্যা শুধু রাজশাহীতে বা বাংলাদেশে কমেনি, এটা সারা বিশ্বেই কমেছে। মূলত ডিজিটাল সুবিধার কারণেই চিঠি কমেছে। মানুষ এখন ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইমেইলে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করছে। ফলে ব্যক্তিগত চিঠি নেই বললেই চলে। অফিসিয়াল চিঠি এখন আসছে। ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর চিঠি অনেক বাড়ছে।’

আজ ১ সেপ্টেম্বর, আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস। আজ লাল-নীল পাতায় বাহারী রঙে মনের না বলা কথা জানিয়ে রঙিন খামে চিঠি লিখতে পারেন আপনিও। যার শুরুতে স্নেহময় এবং শেষে থাকবে ইতি তোমারই। শুধু প্রেয়সী কিংবা প্রিয়তম একে অপরকে নয়; বাবাকে যে আপনি ভালোবাসেন, সে কথা হয়ত মুখে কখনও বলতেই পারেননি, চিঠিতে বাবাকে জানাতে পারেন সে কথা। মাকেও চিঠি লিখতে পারেন আজ। পুরোনো কোনো এক বন্ধু, যে আপনার ছেলেবেলা জুড়ে আছে, এখন হয়তো যার সাথে বেশি যোগাযোগ নেই, তাকেও চিঠি লিখতে পারেন। সংসার জীবনের অনেকদিন পার করে যাদের ভেতরে এখন আর রোমান্টিকতা নেই, তারাও একে অপরকে মমতায় ভরা চিঠি লিখতে পারেন।

ডিবিসি/আরপিকে

আরও পড়ুন