জানা-অজানা

৭০ বছরেও দেখতে তরুণীর মতো যে গ্রামের নারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডিবিসি নিউজ

রবিবার ২৬শে মার্চ ২০২৩ ০৭:০১:৫১ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

বর্তমান পৃথিবীতে যেখানে ৮০ বছর বয়স পেরুতে কষ্ট হয়ে যায়, সেখানে একটি উপজাতির মানুষদের ১৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচার নজির রয়েছে। যেখানে মানুষ যৌবন ধরে রাখতে, বার্ধক্য ঠেকিয়ে রাখতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে যাচ্ছে, সেখানে তাদের একজন ৯০ বছরেও বাবা হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এমনকি একজন ৭০ বছরের মহিলারাও অনায়াসে গর্ভবতী হন ও স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসব করেন।

পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট-বালতিস্তান প্রদেশ। কারাকোরাম, পশ্চিম হিমালয়, পামির ও হিন্দকুশ পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা ছবির মতো সুন্দর এ প্রদেশের উত্তরেই আছে হুনজা উপত্যকা। এ উপত্যকাতেই বাস করে রহস্যময় হুনজা বা বুরশো নামের  একটি জনগোষ্ঠী।

পাকিস্তানের উত্তরে হুনজার একদিকে চীনের জিনজিয়াং, অন্যদিকে আফগানিস্তান। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রিন্সলি স্টেট ছিল এটা। ব্রিটিশরা হুনজা দখল করার সময় শেষ রাজা (মীর) সাফদার খান চীনে চলে যান। সেই সূত্রে এই পাহাড়ি জনপদের ওপর চীনেরও দাবি ছিল বহুকাল। কথিত আছে হুনজার শাসকেরা আলেক্সান্ডারের সৈনিক দলের বংশধর।

ভারত ভাগের সময় ৩ মাস হুনজা সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল কোন দিকে যাবে। সর্বশেষ ১৯৪৭-এর নভেম্বরে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। পরে পাকিস্তান এটা জুড়ে দেয় গিলগিট-বালতিস্তানের সঙ্গে। গিলগিট বালতিস্তান আবার একদা ছিল জম্মু-কাশ্মীরের অংশ। উপনিবেশ-উত্তর দক্ষিণ এশিয়ার নানান প্রান্তিক অঞ্চল যেভাবে ২-৩টি রাষ্ট্রের কাছে হাতবদল হয়েছে হুনজার ইতিহাস তেমনই।

হুনজা জনগোষ্ঠীর দীর্ঘায়ু হওয়ার রহস্য নিয়ে প্রায় একশো বছর ধরে চর্চা চললেও তা বিশ্বের কাছে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে ১৯৮৪ সালে। ইংল্যান্ডের হিথরো বিমানবন্দরে পাকিস্তান থেকে আসেন সৈয়দ আব্দুল মবুদু নামে এক বৃদ্ধ হুনজা। পাসপোর্টে তার জন্ম তারিখ দেখে চমকে যান ইমিগ্রেশন অফিসাররা। পাসপোর্টে সৈয়দ আব্দুল মবুদু্র জন্ম সাল দেওয়া ছিল ১৮৩২। মানে তার বয়স তখন ছিল ১৫২ বছর। ইমিগ্রেশন অফিসাররা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে মানুষ এতদিন বাঁচতে পারে। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে সাড়া পড়ে যায় বিশ্বে। গবেষকরা দলে দলে আসতে শুরু করেন হুনজা উপত্যকায়।

যেখানে সারা পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু ৬৭, সেখানে হুনজাদের গড় আয়ু নাকি ১২০ বছর! হুনজা উপত্যকায় এর চেয়েও বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা নেহাত কম না। জাপানকে আয়ুর ক্ষেত্রে স্লগ ওভারে  হারিয়ে দিচ্ছেন হুনজারা।

১০০ বছর বয়সেও যথেষ্ট শক্ত সামর্থ্য থাকা হুনজা পুরুষ ও নারীদের এত বছর বাঁচার মূল রহস্য খুঁজেছেন বিজ্ঞানীরা। বেশকিছু ব্যাখ্যাও দাঁড় করিয়েছেন তারা। সব বয়সের নারী-পুরুষই সুর্যোদয় হতে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পরিশ্রম করে কাটান। একজন ৮০ বছরের হুনজা বৃদ্ধের কাছে দৈনিক ১০-১৫ কিলোমিটার পাহাড়ি পথে হাঁটা দুধভাত। ৪০ কেজি শস্য বোঝাই বস্তা অনায়াসেই তারা ক্ষেত থেকে নিয়ে ফেরেন৷

হুনজারা সারাদিনে মাত্র দুবার খাবার খান। সূর্য ওঠার পরে একটা ভারী ব্রেকফাস্ট ও সূর্যাস্তের পরে হালকা ডিনার। এই শেষ; এর মাঝে হুনজারা আর কোনো খাবার খান না।

তারা সবসময় প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে থাকেন। হুনজারা তাদের খাদ্যতালিকায় রাখেন প্রচুর পরিমাণে শুকনো অ্যাপ্রিকট (খোবানি), লেবু জাতীয় ফল, বাদাম, শিম, ভুট্টা, বার্লি ও বাজরার মতো শস্য। মাখন, পনির, ডিম ও দুধ তুলনায় কম খান হুনজারা। মাংস প্রায় খানই না। খেলেও বছরে এক দুবার ভেড়া বা মুরগির মাংস খান। অন্য কোনো মাংস খান না। এছাড়াও, তুমুরু নামে, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর এক প্রকার উদ্ভিদের পাতা ফুটিয়ে চায়ের মতো পান করেন হুনজারা।

প্রাচীন রীতি মেনে হুনজারা বছরে ৪ মাস শুকনো অ্যাপ্রিকট ফলের গুঁড়োর শরবত ছাড়া আর কিছু খান না। দুর্গম স্থানে বাস করার কারণে এবং বিভিন্ন কাজে প্রতিদিনই হুনজাদের প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়। প্রয়োজনীয় খাদ্য ও সবজি নিজেরাই উৎপাদন করেন। এ ছাড়া হুনজারা সব কথাতেই হাসেন। হাসি ঠাট্টা তামাশা তাদের জীবনের অন্যতম অঙ্গ।

তাদের অন্যতন প্রধান খাদ্য অ্যাপ্রিকট ফল। বিজ্ঞানীদের মতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-১৭ সমৃদ্ধ এ ফলটি অধিক পরিমাণে খাওয়ার কারণেই বিশ্বের একমাত্র ক্যান্সার-টিউমার ফ্রি জাতি এই হুনজা উপজাতি।

একদল গবেষক মনে করেন, হুনজাদের দীর্ঘ জীবন আর নিরোগ থাকার পেছনে আছে দুষণমুক্ত বাতাস, হিমবাহ থেকে আসা প্রাকৃতিক মিনারেল ওয়াটার, সারাবছর হিমশীতল পানিতে গোসলের অভ্যাস। শীতকালে হুনজা উপত্যকা বরফে ঢেকে যায়, তখনও হুনজারা গরম পানিতে গোসল করেন না। হুনজারা খান কম, কিন্তু পরিশ্রম করেন বেশি।

কিছু গবেষক বলছেন হুনজারা নিরুত্তাপ ও উদ্বেগহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাই তারা মানসিক চাপের সঙ্গে যুক্ত অসুখবিসুখে ভোগেন না। তারা শিশুদের মতোই জীবন যাপন করেন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেন। এটাই তাদের দীর্ঘায়ু হওয়ার রহস্য।

আরেকটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, হুনজায় শিক্ষার হার ৯০%। যেখানে আমাদের শহরাঞ্চলের শিক্ষার হারও আরও অনেক কম!

শিশুকাল থেকেই এই সম্প্রদায়ের মেয়েদের সৌন্দর্য বিকশিত হতে শুরু করে। এসব নারীর সৌন্দর্যের একটি গোপন রহস্য হলো, তারা পানির চেয়ে ফলের জুস/শরবত পান করে বেশি। তাদের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের আরেক কারণ হলো শারীরিক ব্যায়াম। উপত্যকায় বাস করা এই হানজা সম্প্রদায়ের মানুষ নিয়মিত শ্বাসক্রিয়ার ব্যায়াম করে, যা তাদের চর্ম ও শরীরকে নানাভাবে উপকৃত করে।

একটা কথা প্রচলিত আছে যে, কাশ্মীরের নারীরা এই উপমহাদেশের সবচেয়ে সুন্দরী। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, হুনজা নারীদের দেখলে আপনি দ্বিধাদ্বন্ধে পড়ে যাবেন যে, কারা আসলে বেশি সুন্দরী ! এখানকার মেয়েরা খুবই লাজুক, সহজে অপরিচিত পুরুষ বা ক্যামেরার সামনে আসতে চায় না।

হুনজা নারীরাও কাশ্মীরিদের মতো মাথায় এক ধরনের টুপি পরে। তারা নিজেদের ভেতর বিবাহের মাধ্যমে বংশধারা অব্যাহত রাখে। বিভিন্ন উৎসবে এরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নাচ-গান করে।

এই অঞ্চলের ৯৫ ভাগ জনগণই মুসলিম। এখানকার প্রধান উৎসব হচ্ছে- ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, ঈদে মিলাদুন্নবীর মতো বিভিন্ন ইসলামিক উৎসব।

ডক্টর রবার্ট ম্যাক্রিসন নামে এক বিজ্ঞানী বেশ কয়েক বছর ধরে হুনজাদের সঙ্গে বসবাস করেছিলেন। তিনি পরবর্তী সময়ে জানান, সেখানে কয়েক বছর বসবাস করার পরও তিনি কোনো ক্যানসার, পেটের আলসার, অ্যাপেনডিসাইটিস বা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে খুঁজে পাননি। যা সত্যিই আশ্চর্যজনক!

আরেক বিজ্ঞানী ডক্টর হেনরি কোয়ান্ডাও তাদের সঙ্গে বসবাস করেছেন। তিনি হিমবাহের পানি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, যা হুনজারা নিয়মিত গোসল ও পান করেন।

কোয়ান্ডা গভীর গবেষণা চালিয়েছেন ও হুনজাদের পানির উপর একটি বই লিখেন। যেখানে তিনি উপজাতির দীর্ঘায়ু হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ বর্ণনা করেছেন।

হুনজার অধিবাসীদের আয়ুষ্কাল বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের কাছে একটি রহস্য হয়ে আছে। কেন তারা এই দীর্ঘায়ু উপভোগ করেন, সেটি জেমস হিলটনের ‘লস্ট হরাইজন’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু ছিল।

হুনজারা বহুদিন বাঁচেন; এই বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন ধরেই গবেষকদের মধ্যে বেশ তর্ক-বিতর্কও আছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন হুনজাদের দীর্ঘায়ু হওয়ার বিষয়টি অতিরঞ্জিত। তারা বলছেন- হুনজারা নিজেরাই নিজেদের বয়স বলেন। বয়সের কোনও নথি নেই। বয়স বাড়িয়ে বলেন। হুনজারা কোনো ক্যালেন্ডার ব্যবহার করেন না। তাই হুনজাদের বয়সের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ কোথায় ?

ডাক্তার জন ক্লার্ক নামে এক চিকিৎসক ১৯৫৬ সালে কুড়ি মাস ছিলেন হুনজা উপত্যকায়। দেশে ফিরে Hunza – Lost Kingdom of the Himalayas নামে একটা বই লিখে ছিলেন। সেই বইতে তিনি লিখেছিলেন হুনজাদেরও রোগ হয়। তিনি ওই ২০ মাসে বিভিন্ন বয়সের ৫,৬৮৪ জন হুনজাকে চিকিৎসা দেন।

তিনি লিখেছিলেন, তার কাছে আসা বেশির ভাগ হুনজা রোগীই ম্যালেরিয়া, কৃমি, চোখের রোগে ভুগতেন। অস্বাভাবিক দ্রুততায় রোগ সেরেও যেত। জন ক্লার্ক, হুনজাদের দীর্ঘায়ু নিয়ে রীতিমত সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে হুনজারা পাকিস্তানের অন্যান্য মানুষদের থেকে গড়ে বেশি দিন বাঁচেন; এ ব্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহ।

গবেষকরা হুনজাদের দীর্ঘায়ু হওয়ার রহস্যকে আতশ কাঁচের তলায় ফেলে নানান গবেষণায় মাতলেও তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই হুনজাদের। কারণ, তারা প্রকৃতির বরপুত্র। তাই প্রকৃতির কোলে, জীবনের পিচে, হাসতে হাসতে রান নিয়ে সেঞ্চুরির পথে এগিয়ে যান হুনজারা। আর অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বিশ্ব।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা সৌন্দর্যমণ্ডিত এই স্থানে ঘুরতে আসেন। একই সঙ্গে তারা হুনজা উপজাতিদের জীবনধারাও কাছ থেকে অবলোকন করেন। পর্যটকদের জন্য সেরা এক গন্তব্য এটি।

হুনজা উপত্যকায় চাইলে যে কোনো সময়ই ভ্রমণে যেতে পারেন পর্যটকরা। তবে হুনজা ভ্রমণের সর্বোত্তম সময় হলো এপ্রিল থেকে অক্টোবর। কারণ গরমে সেখানে তাপমাত্রা সর্বাধিক ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে।

হুনজা ভ্রমণে যা যা ঘুরে দেখবেন, সে সবের মধ্যে আছে- রাকাপোশি চূড়া, করিমাবাদ, আলিতিত দুর্গ, বাল্টিত দুর্গ, আত্তাবাদ লেক, রাশ লেক, সোস্ট বর্ডার, গুলমিত জমা দিন, বোরিথ লেক ও ঈগল নেস্ট ডুইকার।

সূত্র: পাকিস্তান ট্যুর এন ট্রাভেল

ডিবিসি/রূপক

আরও পড়ুন