বাংলাদেশ, জাতীয়

সালামি আর ঈদের যোগসূত্র কোথায়?

ডেস্ক নিউজ

ডিবিসি নিউজ

শনিবার ২২শে এপ্রিল ২০২৩ ০৭:৩৮:৪২ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

ঈদ মানে খুশি। এই খুশি বহুগুন বাড়িয়ে দেয় সালামি। বিশেষত শিশুরা তো সালামিকে উৎসবের অনুষঙ্গ করে ফেলেছে। দেখা যায় বড়রাও কম যান না। ঈদ আর সালামি এখন যেন একইসূত্রে গাঁথা।

ঈদসালামির সূচনাকাল নিয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। ধারণা করা হয়, ১০ম শতাব্দীতে ফাতিমীয় খিলাফতের যুগে মিশরে সালামি প্রথার সূচনা। এ সময় ঈদের দিন বড়রা ছোটদের হাতে কিছু পরিমাণ পয়সা তুলে দিতেন। এই প্রথা তখন ‘ঈদি’, ‘হাদিয়া’ প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। ক্রমে অটোমান সাম্রাজ্য ও আরবেও ঈদি বিনিময়ের রীতি সম্প্রসারিত হয়। কেবল নগদ অর্থ নয়, রুচিভেদে কেউ কেউ নতুন কাপড়, মিষ্টিও ঈদির তালিকায় যুক্ত করেন।

এই ভূখণ্ডে ঈদ–উৎসবের পরিসর খুবই সমাকীর্ণ। এর পেছনে রয়েছে দুটি কারণ: এক. গ্রামবাংলার মুসলমানরা ছিলেন দরিদ্র; দুই. মুসলমানের মধ্যে স্বতন্ত্র কমিউনিটির বোধ তখনো প্রবল হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটি সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সহজ ছিল না।

নবাব-বাদশাহরা ঈদ করতেন, তবে তা সীমিত ছিল অভিজাত উচ্চবিত্তের মধ্যে, উৎসব হিসেবে ঈদের তাৎপর্য জনসাধারণের নাগালের বাইরে ছিল। তবে উনিশ শতক ধরে চলা ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে গ্রামীণ ও নগরজীবনের উৎসবে নতুনত্বের ছোঁয়া লাগে। আর বিশ শতকের চতুর্থ দশক থেকেই ঈদ–উৎসব সর্বব্যাপী ছড়িয়ে যেতে শুরু করে।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর বাংলাদেশের উৎসব (১৯৯৪) বইয়ে লিখেছেন, বাংলাদেশের ঈদ–উৎসবের বয়স বড়জোর ৪০ থেকে ৫০ বছর। তিনি এটাও বলেছেন, ঢাকা, কলকাতা প্রভৃতি শহরে নাচ, গান ও মিছিলের সমন্বয়ে ঈদ উদ্‌যাপনের চিত্র পাওয়া গেলেও গ্রামবাংলার তেমন উল্লেখযোগ্য খবর পাওয়া যায় না।

ঢাকাবিষয়ক গবেষক দেলওয়ার হাসান নওয়াবাহার–ই মুর্শিদ কুলি খান বইয়ের লেখক আজাদ হোসেনী বিলগ্রামীর লেখার বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, ‘নওয়াব সুজাউদ্দিনের অধীন মুর্শিদ কুলি খান (১৭০৪-২৫) ঈদের দিনে ঢাকার দুর্গ থেকে ঈদগাহর ময়দান পর্যন্ত এক ক্রোশ পথে প্রচুর পরিমাণ টাকাকড়ি ছড়িয়ে দিতেন।’ শামসুজ্জামান খানের মতে, এই বর্ণাঢ্য আয়োজনে সনাতনদের উৎসবের একটি প্রভাব পড়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।

সুফিয়া কামাল তাঁর একালে আমাদের কাল স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘আমলা-কর্মচারী, ডাক্তার-কবিরাজ এঁরা ছিলেন হিন্দু। তাঁদের পালাপার্বণ-পূজায় জমিদারের খরচায়ই উৎসব হতো। ভোজও তাঁরা জমিদারকে দিতেন ‘সম্মানী’ নজরসহ। তাঁদের দেওয়া উপহার পায়েস ‘পরমান্ন’-নাড়ু-মণ্ডা মিষ্টি যে কত খেয়েছি। আবার তাঁদেরও দিতে হতো সম্মানী টাকা। সাহেব, বেগম সাহেবা, ফুফুজান, খালাআম্মা, আপাজান, দুলাভাই সাহেবদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ পেতেন সেলামি বাবদ।’

সুফিয়া কামালের বর্ণিত সালামির বিবরণ বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের। এর কাছাকাছি সময়ের কথা উল্লেখ করে শামসুজ্জামান খান তাঁর বাংলাদেশের উৎসব (২০১৩) বইয়ে লিখেছেন, ‘তখনো ঈদে সেলামির চল হয়নি, তবে বাড়ির কাজের লোক, পাটনি, নাপিত এরা বকশিশ পেত।’

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যদিও একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল, কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ–উৎসবের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। আশির দশক থেকে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের বিপুল বিস্তার ঘটে। বিদেশের শ্রমবাজারগুলোতে বাংলাদেশের মানুষজন কাজ করতে শুরু করেন। এসব কারণে গ্রাম ও শহরের মধ্যকার আর্থিক ব্যবধান ঘুচতে থাকে। এই আর্থিক সচ্ছলতার ভিত্তিতেই গত ৪ দশকে বাংলাদেশের ঈদ–উৎসব যেমন ব্যাপকতা পেয়েছে, তেমনি সর্বজনীন হয়ে উঠেছে।

ঈদ–উৎসবের আনন্দ সব সময় সবার কাছে সমান হয়ে আসে না। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় যেমনটা পাওয়া যায়, ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/ মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’ অনেকের কাছে ঈদ ভালো খাওয়া, কাপড় পরা নয়, সালামি তো নয়ই। ফলত ঈদ–উৎসবের মতো সালামিও সর্বাঙ্গীণ হয়ে উঠতে পারেনি। যেদিন বিত্তবণ্টনে সাম্যাবস্থা আসবে, সেদিনই ঈদ–উৎসব যেমন সর্বাঙ্গীণ রূপ লাভ করবে, তেমন ঈদসালামিতেও আসবে নতুন সমারোহ।

আরও পড়ুন