সাকরাইন উৎসব

কীভাবে এলো এই ঘুড়ি আর এ দিন

ফরহাদ ইবনে মালেক

ডিবিসি নিউজ

শুক্রবার ১৪ই জানুয়ারী ২০২২ ০১:০১:২২ অপরাহ্ন
Facebook NewsTwitter NewswhatsappInstagram NewsGoogle NewsYoutube

পৌষ সংক্রান্তির পিঠার আমেজে পুরান ঢাকার মানুষের এক নিজস্ব উৎসব, বাঙ্গালীর আকাশে ওড়ার দিন।

“মাঘের সাথে হাত মিলিয়ে, নীল আকাশে মন খেলিয়ে
কুয়াশাদের চাদর ফেলে, ওই এসেছে ডানা মেলে
যেন অবাধ ওড়াওড়ি; সুতোয় বাঁধা ঘুড়ি”

ঘুড়ি। দূরের নীল আকাশ আর মাটি, এই দুয়ের প্রেমের সে যেন এক ডাকপিয়ন। চোখের সামনের ঘুড়ির ছবি ভাসতেই ভেসে ওঠে শৈশবের ফেলে আশা অবুঝ দিনগুলোর কথা। তবে ঘুড়ি ওড়ানো শুধুমাত্র শৈশবের শখ নয়। এ এক এমন শখ, যা কিশোর থেকে যুবক কিংবা মধ্যবয়সী, এমন দিনে সবার মনেই দোলা দিয়ে যায়। 

কীভাবে এলো এ ঘুড়ি

ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের কাগজের ঘুড়ি নীল আকাশে উড়লেও শুরুর দিকে কিন্তু এ ঘুড়ি কাগজের ছিল না। শুরুর দিকে তা ছিল পাতলা সিল্কের কাপড়ের তৈরি ঘুড়ি। কাগজ আবিষ্কারের পর কাপড়ের জায়গা দখল করে নেয় তা। ঘুড়ি আবিষ্কার বেশকিছু তথ্য পাওয়া যায়। কারো মতে, ঘুড়ির আবিষ্কার হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সনে গ্রিসের ট্যারাস্টাস শহরে। লোকমুখে প্রচলিত, এই শহরের আর্কিটাস নামের এক ভদ্রলোক প্রথম আকাশে ওড়ানোর ঘুড়ি তৈরি করেছিলেন। তবে আরেকটা জোরালো মত হচ্ছে, তারও অনেক পরে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সনে চীন দেশের রাজা হান সিন নামের এক সেনাপতি প্রথম এ ঘুড়ি তৈরি করেছিলেন। আবার কারো মতে, প্রায় ২,৮০০ বছর আগে প্রাচীনকালের ছুনছিউ আমলে মুওছু নামের একজন দার্শনিক ৩ বছর সময় ধরে কাঠ দিয়ে একটি ঘুড়ি তৈরি করেছিলেন। আর এটিই বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ঘুড়ি বলে বিবেচিত। এরপর ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইটালিয়ান পর্যটক মার্কো পোলোর  মাধ্যমে ইউরোপের মানুষ ঘুড়ির কথা জানতে পারে। যদিও ঘুড়ির স্বর্ণযুগ বলা হয় ১৮৬০ সাল থেকে ১৯১০ পর্যন্ত সময়কে।

বিজ্ঞানে ঘুড়ি

তবে আবিষ্কার যে ই করুক, এ আবিষ্কার যে বিজ্ঞানের আশীর্বাদ হয়ে এসেছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। উদাহরণস্বরূপ, ১৭৪৯ সালে আলেকজান্ডার উইলসন ঘুড়িতে থার্মোমিটার লাগিয়ে ঊর্ধ্বাকাশের তাপমাত্রা মাপার চেষ্টা করেন। ১৯০১ সালের ১২ ডিসেম্বর ঘুড়ির মধ্যে অ্যান্টেনা লাগিয়ে বৈজ্ঞানিক মার্কোনি আকাশের ইলেকট্রোম্যাগনেটিভ ওয়েভ ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, ১৭৫২ সালে বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন আকাশে একটি সিল্কের ঘুড়ি উড়িয়ে তার সাহায্যে প্রস্তুত বিদ্যুৎ ও আকাশের বিদ্যুৎ যে একই তা প্রমাণ করেছিলেন।

ঘুড়ির নাম ও বৈচিত্র

বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ডাকা হয় এই বিনোদনের অংশকে। ইংরেজিতে বলা হয় কাইট (KITE), যার অর্থ চিল বা বাজ পাখি। ঘুড়িতে চিলের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় বলে এর নাম কাইট (KITE) রাখা হয়। বাংলা ঘুড়ি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘ঘূর্ণ’ শব্দ থেকে। তবে আঞ্চলিক বাংলায় এটি গুড্ডি বা ঘুড্ডি নামেও পরিচিত। ঘুড়ির এ নামটি আবার এসেছে হিন্দি ‘গুড্ডী’ শব্দ থেকে। জাপানে একে ডাকা হয় ‘তাকো’, ফ্রান্সে ‘সেফ ভোলেন্ট’, চায়নায় ‘ফুঙ জুঙ’, মেক্সিকোতে ‘পাপালোতে’ নামে। যে নামেই তাকে ডাকা হোক না কেন, সব দেশেই এটি আকাশে ওড়ানো হয়। ঘুড়ির নাম যা ই হোক, আকার ও আকৃতিতে এর রয়েছে বেশ বৈচিত্র। মাছ, পাখি, ফুল, বাঘ, সিংহ, ড্রাগন, ব্যাঙ, সাপ-কতো আকৃতিরই না ঘুড়ি তৈরি হচ্ছে এখন। নানান দেশের নানান মানুষ ঘুড়ির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছে নিজেদের সংস্কৃতি, মিথ, এমনকি ধর্মও। 

মুসলমান আমলে বিভিন্ন সময়ে নানা রকমের ঘুড়ি দেখা গেছে। যেমন নকাওয়া, চংগ, তুলকল, পতংগ, গুডডি প্রভৃতি। আমাদের দেশের ঘুড়ি আর মালয়েশিয়ার ঘুড়ির মিল অনেক। নানা রঙের কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের তৈরি ঘুড়িকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন, চাঁদিয়াল, ঢুপিয়াল, ঘয়লা, চৌরঙ্গী ইত্যাদি। ভারতবর্ষে নেতা বা সিনেমার নায়কদের ছবি ঘুড়িতে লাগিয়ে ঘুড়ি ওড়াতে দেখা যায়।

ঘুড়ির উৎসব
 
১৯৮৪ সাল থেকে জানুয়ারি ৮ থেকে ১৪ তারিখের মধ্যে আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করা হয়। ঘুড়ি খেলার আন্তর্জাতিক সংগঠন বিশ্ব ঘুড়ি ফেডারেশনের প্রধান কার্যালয় চীনের ওয়ে ফ্যাং শহরে অবস্থিত। পৃথিবীর অনেক দেশেই ঘুড়ি উড়ানো জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। চীন, জাপান, তাইওয়ানের মতো দেশে তো ঘুড়ি ওড়ানোকে কেন্দ্র করে সরকারি ছুটির ঘোষণা করা হয়। অনেক দেশে ঘুড়ি ওড়ানোকে ধর্মীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে গণ্য করা হয়।

বাংলাদেশের ঘুড়ি উৎসবের ইতিহাসও অনেক পুরোনো। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো ঘুড়ি উৎসব হলো পুরোনো ঢাকার পৌষ সংক্রান্তির ঘুড়ি উৎসব। যা সাকরাইন নামে পরিচিত। এ দিন পুরান ঢাকা সহ ঢাকার বিভিন্ন ছাদ ও খোলা জায়গায় ঘুড়ি ওড়ানোর আয়োজন করা হয়। তবে মোঘল আমল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ ঘুড়ি নিয়ে উৎসব করে আসছে। নবাবরাই প্রথম শুরু করে এই ঘুড়ি উৎসব। ধীরে ধীরে এই উৎসব পুরোনো ঢাকার মানুষের নিজস্ব পরিচিতির এক উৎসবে পরিণত হয়।

আরও পড়ুন