ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টায় ভিজিট ভিসায় আরব আমিরাতের দুবাই পাড়ি দিয়ে লিবিয়া যাচ্ছে বাংলাদেশিরা। মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে কেউ জীবন নিয়ে দেশে ফিরলেও, নৌকাডুবে সাগরে মারা যাচ্ছে তাদের একটি বড় অংশ।
চলতি বছর ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে সমুদ্র থেকে উদ্ধার হওয়াদের তালিকায় শীর্ষে বাংলাদেশ। ইউরোপে প্রবেশমুখের দেশগুলোতেও আটকা পড়ে আছে কয়েক হাজার বাংলাদেশি।
লিবিয়া ফেরত বাংলাদেশি মিলন ব্যাপারী জানান,'শিপটা যদি পাঁচ মিনিট লেট করে আমাদের যেয়ে উদ্ধার করতো তাহলে আমরা সবাই মারা যেতাম। বোট দিয়ে আমরা পার হই ইতালি, ওটাকে ওরা বলে গেইম। গেমের জন্য আড়াই লাখ টাকা দিতে হয়। মোট সাত লাখ টাকা।'
সামনেই মৃত্যুর ফাঁদ জেনেও ছোট্ট নৌকায় ভেসে ভুমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি ঢোকার চেষ্টাকে মানবপাচারকারীরা বলে ‘গেম’। খেলা তো বটেই, জীবনমরণ খেলা, যেখানে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুর নিশ্চয়তায় বেশি।
মিলন ব্যাপারী আরও জানান,'বাংলাদেশি দুইটা বোট ছিলো। একটা ফেঁটে ৮৪ জন মারা গেছে। আমাদেরটা থেকে ৪ জন। আমাদের বোটও ফেঁটে যায়। আমাকে যখন উঠায়ছে আমরা শরীর তখন পুরা লবনে ভরা। আমি পাঁচ দিন অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ছিলাম। সবাই ভেবেছিলো আমি মারা গেছি।'
শরিয়তপুরের মিলন ব্যাপারী ইতালিতে যাওয়ার উদ্দেশে ভিজিট ভিসায় দুবাই থেকে মিশর হয়ে লিবিয়াতে যান গেল এপ্রিলে। ত্রিপলী বন্দর থেকে ভুমধ্যসাগর পাড়ি দিতে ছোট্ট কাঠের নৌকায় গাদাগাদি করে রওনা দেন অন্য আরো ১১৬ জনের সাথে। সাগরে ভাসার আগেই লিবিয়ায় থাকা বাংলাদেশি দালাল শফিক সাইককে সাড়ে ৭ লাখ টাকা দেন মিলন ব্যাপারী, শরিয়তপুরে বাড়ি শফিক সাইকের স্ত্রী হেনা বেগম মিলন ব্যাপারীর পরিবারের কাছ থেকে নেন সেই টাকা।
মাঝপথে সাগরে নৌকা ডুবে গেলে, তিউনিশিয়া কোস্ট গার্ড উদ্ধার করে ওই নৌকায় থাকা আরো ৬৪ জন বাংলাদেশিকে। সেখান থেকে ১লা জুলাই আইওএমের সহায়তায় দেশে ফেরেন মিলন ব্যাপারীসহ ১৭ বাংলাদেশি।
লিবিয়া ফেরত বাংলাদেশি আল আমিন বলেন,'টার্গেট ছিলো যে, ইতালিতে ঢুকতে পারলে অনেক টাকা বেতন পাবো। বলছি টায়ায় হয় তো যাবে। বলে কাঠের ট্রলার। কাঠের ট্রলার দুর্ঘটনায় পড়ে মাঝ সাগরে।'
দুদিন আগে গেলো বৃহষ্পতিবার একইভাবে লিবিয়া থেকে ইতালি পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবে মারা গেছেন ১৭ বাংলাদেশি। উদ্ধার করা হয়েছে বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের ৩৮০ জনকে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ভুমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৩হাজার ৩৩২জনকে। ইউরোপের উদ্দেশে ভুমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে ওঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। এরপরই রয়েছে তিউনিশিয়া আর সিরিয়া।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শরিফুল হাসান বলেন,'ওই সব দেশে যারা যায়, তাদের অনেকের আত্মীয় স্বজনই ইতালি, গ্রীস বা ইউরোপের অনেক দেশেই আছে। তারা তাদেরকে এক ধরণের প্রলোভন দেখায়। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে যে, তাদের লোকাল পাচারকারী কারা ছিলো। আন্তর্জাতিক পাচারকারী কারা ছিলো। এভাবে সমন্বয় করে। অভিযান চালাতে হবে।'
আইওএমের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে বলকানের পশ্চিমাঞ্চলের দেশগুলোর সীমান্তকে ইউরোপে ঢোকার রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করে ১ হাজার ৩২০ জন বাংলাদেশি। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ৬ হাজার ৬২৫জনে। নৌ ও স্থল সীমান্ত দুই পথই ব্যবহার করে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করে তারা। ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ৮ হাজার ৮৪জনে।
সাবেক আইওএম কর্মকর্তা আসিফ মুনীর বলেন,'আমার ভাই বা বন্ধু ওখানে গেছে। সে কোন না কোন ব্যবস্থা করে ওখানে থাকতে পারছে আমি কেন পারবো না? দেশে এবং বিদেশে যে সংঘবন্ধ চক্র আছে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনা এবং আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যৌথভাবে করতে হবে।'
আইওএমের হিসেবে বলকান অঞ্চলের এসব দেশের স্থল সীমান্তে আটকা পড়ে আছে কয়েক হাজার বাংলাদেশি।