সৌদি আরবের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে নারকীয় একটি ঘটনা হচ্ছে ১৯৭৯ সালে মক্কা নগরীতে কট্টরপন্থীদের অবরোধ। ইসলামের পবিত্রতম স্থান কাবা এবং একে ঘিরে তৈরি মসজিদুল হারাম বা হারাম শরিফ অবরোধ করেছিল একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। এ ঘটনায় জামাতে নামাজ বন্ধ ছিল ২ সপ্তাহ। শুধু তাই নয়, দখল থেকে মক্কাকে মুক্ত করতে তীব্র লড়াই চলে। তাতে নিহত হয় শত শত মানুষ।
১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বর। ১৪০০ হিজরির প্রথম দিন, অর্থাৎ মহররম মাসের ১ তারিখ ভোরবেলা। ফজরের নামাজের প্রস্তুতি চলছিল মক্কার মসজিদুল হারাম তথা পবিত্র কাবায়।
ঠিক এমন সময় কাবা চত্বরে শোনা গেল মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ। হতচকিত হয়ে পড়েন মুসল্লিরা। কী হচ্ছে – কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইমামের মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে এক ব্যক্তি বিকট কণ্ঠে বক্তৃতা শুরু করলেন। সৌদি সরকারের (তৎকালীন) দুর্নীতি এবং একনায়কতন্ত্রের ব্যাপারে বিষোদ্গার করা হলো কিছুক্ষণ। এরপর কিছু হাদিস আর ভবিষ্যদ্বাণী শুনিয়ে তার পাশে দাঁড়ানো এক ব্যক্তিকে ‘ইমাম মাহদি’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আর বললেন, সবাইকে এখন তার হাতে বায়াত হতে হবে।
মুসল্লিরা দেখতে পেলেন কাবা চত্বরের চারপাশে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে গেছে শত শত (প্রায় ৪০০) সশস্ত্র ব্যক্তি। তারা মসজিদুল হারাম থেকে কাউকে বেরোতে বা ঢুকতে দিচ্ছেন না। মসজিদের সকল গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মসজিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন অল্প সংখ্যক পুলিশ। হারামের পবিত্রতা রক্ষায় তাদের কাছে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। ফলে দু’জন পুলিশকে মসজিদেই হত্যা করে কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো মসজিদ অবরুদ্ধ করে ফেলল সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
মসজিদুল হারামের মধ্যে এই সন্ত্রাসী ঘটনার মূল হোতা ছিলেন জুহাইমান আল-ওতাইবি, সৌদি আরবের নজদের প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য। আর যাকে ‘ইমাম মাহদি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল, তিনি জুহাইমানের নিজেরই শ্যালক মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল-কাহতানি। জুহাইমানের সঙ্গে কাহতানির দেখা হয় জেলে বন্দী থাকা অবস্থায়। জুহাইমান তাকে সেখানে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ্ তো আমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছেন যে, তুমি হলে মাহদি।’ এরপর শুরু হয় ব্রেনওয়াশ করা। এক পর্যায়ে কাহতানি নিজেই বিশ্বাস করা শুরু করেন যে, তিনি নিজেই মাহদি।
জুহাইমানের সঙ্গে সৌদি রাজপরিবারের বংশগত শত্রুতা ছিল বেশ পুরোনো। বিংশ শতকের শুরুর দিকে আল-সৌদ পরিবার যখন হেজাজ দখল করে নেয়, তখন তারা অনেক প্রভাবশালী পরিবারকে দমন করে নিজেদের শাসনক্ষমতার ভিত দাঁড় করান। সেসব প্রভাবশালী পরিবারের মধ্যে জুহাইমানের পরিবারও ছিল। সেই থেকে এ পরিবার সবসময় সৌদ পরিবারকে যে কোনোভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার স্বপ্ন দেখে আসছে।
এর আগে ছোটখাটো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও সরকারবিরোধী কার্যক্রমের জন্য জুহাইমানকে ১৯৭৮ একবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সেই গ্রেপ্তারকালীনই তার সঙ্গে দেখা হয় আল-কাহতানির। এরপর দু’জনের বন্ধুত্ব হয় এবং আল-কাহতানির বোনকে বিয়ে করার মাধ্যমে বন্ধুত্ব আত্মীয়তায় রূপ নেয়। তারা তাদের গোপন কর্মকাণ্ড শুরু করার পর বুঝতে পারেন, একা একা এভাবে কাজ হবে না। তাই তারা যোগদান করেন মদিনার একটি স্থানীয় সালাফি গ্রুপে, যার নাম ছিল ‘আল-জামা আল-সালাফিয়্যা আল-মুহতাসিবা’। সেই সালাফি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন প্রখ্যাত শাইখ এবং শিক্ষক আব্দুল আজিজ বিন বাজ, সৌদির ফতোয়া কমিটির প্রধান। অবশ্য জুহাইমানের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না।
আরও পড়ুন: সাঁতরে কাবা তাওয়াফ করেছিলেন যিনি
এই সালাফি গ্রুপ থেকে জুহাইমান নিজের উগ্র মতানুসারী ব্যক্তিদের বাছাই করতে থাকেন। একইসঙ্গে চলতে থাকে কাবা আক্রমণের প্রস্তুতি। তিনি নিজের পরিবার ছাড়াও অনেক ধনী মানুষের কাছ থেকে অনুদান পান। ফলে অস্ত্রশস্ত্র কিনতে তাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। তাছাড়া এই গ্রুপটি খুবই সশস্ত্র আর প্রশিক্ষিত ছিল। জুহাইমান নিজেই ছিল প্রাক্তন সেনা সদস্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা প্রচুর অস্ত্র, গুলি, গ্যাস মাস্ক আর খাবার-দাবার নিয়ে জমিয়ে রাখেন হিজরি নতুন বছরের এক সপ্তাহ আগে থেকে। এসব অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল মসজিদের নিচের শত শত ছোট্ট কক্ষে, লাশের খাটিয়ায় করে এগুলো নিয়ে আসা হয় বলে বর্ণিত আছে।
অবশেষে ১৪০০ হিজরির প্রথম দিন (১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বর) তারা মসজিদুল হারামে ঢুকে পুরো মসজিদ অবরোধ করেন এবং মসজিদে সমবেত সকলকে নির্দেশ দেন মুহাম্মদ আল-কাহতানির হাতে বায়াত গ্রহণের।
বলা হলো, এই লোকের নাম মুহাম্মাদ, বাবার নাম আব্দুল্লাহ, ঠিক যেমনটা রাসুল মুহাম্মাদ (স)-এর ছিল। আরও বলা হলো, তিনি মক্কার উত্তর থেকে এসেছেন। আর দিনটি ছিল হিজরি ১৪০০ সালের প্রথম দিন! জুহাইমান দাবি করলেন, ইনিই সেই কাঙ্ক্ষিত ‘ইমাম মাহদি’। আপনারা সবাই তার হাতে বায়াত গ্রহণ করুন।
এখানে জুহাইমান ছোট একটা ভুল করে বসলেন। আর সেটা হলো- ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী নেতৃত্ব নিতে ইমাম মাহদি-এর নিজের রাজি হবার কথা নয়, কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি নিজেই রাজি এবং লোকদের বাধ্য করা হচ্ছে তার আনুগত্য স্বীকার করতে।
সে সময় মসজিদুল হারাম সম্প্রসারণের কাজ চলছিল। এ কাজ করছিল সবার পরিচিত বিন লাদেন কনস্ট্রাকশন গ্রুপ। তাদেরই এক কর্মকর্তা সর্বপ্রথম এই কাহিনী দেখে ফোন করে বাইরে জানিয়ে দেন সেখানে কী ঘটছে তা। ঠিক এর পরই সন্ত্রাসীরা কেটে দেয় টেলিফোন তার। কিন্তু বিশ্ব জেনে যায় কিছু একটা হচ্ছে মসজিদুল হারামের ভেতরে।
জুহাইমানের সন্ত্রাসীরা অনেক বন্দীকে ছেড়ে দেয় বটে, কিন্তু অনেককেই আটকে রাখে। মসজিদের উপরে ‘ডিফেন্সিভ পজিশনে’ চলে যায় তারা, মিনারে মিনারে ‘স্নাইপার’ তাক করে রাখে। আর বাকি সবাই আশ্রয় নেয় মাটির নিচে। বাইরের কেউ জানত না যে, ভেতরে ঠিক কতজন জিম্মি। কেউ এটাও জানত না ভেতরে কী হচ্ছে, ক্ষয়ক্ষতি কেমন! এরা কারা, কী চায়, কী করবে?
এদিকে, সৌদি প্রিন্স ফাহাদ তখন একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে তিউনিসিয়াতে ছিলেন। আর ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান প্রিন্স আব্দুল্লাহ ছিলেন মরক্কোতে। সৌদি বাদশাহ খালিদ তাই এই মিশনের দায়িত্ব দেন প্রিন্স সুলতানের উপর, যিনি ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে। সঙ্গে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স নায়েফ।
মসজিদুল হারাম পুনরুদ্ধারে তারা ১০০ পুলিশ পাঠান। যেহেতু সন্ত্রাসীরা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল, সেহেতু পুলিশকে আসতে দেখেই তারা গুলিবর্ষণ শুরু করে, ফলে অনেক পুলিশ অকাতরে প্রাণ হারায়। পরে সৌদি আর্মি আর ন্যাশনাল গার্ড যোগদান করে তাদের পুলিশের সঙ্গে।
নিজেদের অপারগতায় সৌদি সরকার তখন পাকিস্তানি আর্মি স্পেশাল ফোর্সের সাহায্য চায়। তারা আসার পর অপারেশনে যোগ দিয়ে রাতের মধ্যেই পুরো মক্কা খালি করে ফেলা হয়! শূন্য হয়ে যায় মক্কা নগরী।
জানা যায়, পাকিস্তান আর্মি স্পেশাল ফোর্সের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল পারভেজ মুশাররফ, যিনি পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন।
কিন্তু উদ্ধার অভিযান যতটা সহজ ভাবা হয়েছিল, ততটা সহজ ছিল না। প্রথমেই আসে ধর্মীয় বাধা। যতটুকু বাইরে খবর গেছে, তা থেকে সৌদির ফতোয়া কমিটি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল – এটি কি আসলেই ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে? নাকি বানোয়াট? অনেক কিছুই মিলছে, আবার অনেক কিছু মিলছেও না।আবার হারাম শরিফ অত্যন্ত পবিত্র স্থান, সেখানে রক্তপাত ঘটানো নিষিদ্ধ। তাহলে সরকারি বাহিনীকে হারাম শরিফে রক্তপাতের আদেশ কি দেওয়া উচিত হবে?
ফতোয়া কমিটির প্রধান ইবনে বাজ অবাক হন এটা শুনে যে, তারই কিছু ছাত্র এ কাজে সম্পৃক্ত! তিনি এজন্য আরও সংশয়ে পড়ে যান- এসব কী হচ্ছে তা ভেবে। এদিকে, কাবার ইমাম মুহাম্মাদ আল-সুবাইল সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এরা সন্ত্রাসী গ্রুপ। তিনি কায়দা করে নারীর পোশাক পরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন হারাম শরীফ থেকে। এরপর পুরো ব্যাপারটি তাদেরকে বুঝিয়ে বলেন।
শেষ পর্যন্ত আর্মিকে গোলাগুলির অনুমতি আর নির্দেশ দেওয়া হয়। আর্মি গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করে, কিন্তু একজন একজন করে মারা পড়তে থাকে প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীদের স্নাইপারের গুলিতে। লাউডস্পিকারে সন্ত্রাসীরা দাবি জানায়, আমেরিকাকে তেল সাপোর্ট আর দেওয়া যাবে না, বাইরের রাষ্ট্রের আর্মি বহিষ্কার করতে হবে ইত্যাদি।
এদিকে, কিছুতে কিছু করতে না পেরে, সৌদি সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে- সন্ত্রাসীদের ভাতে মারবে। কিন্তু বোঝা গেল, তারা প্রচুর খেজুর নিয়ে ঢুকেছে, আর জমজম কূপ থাকায় পানিরও সমস্যা নেই তাদের। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, এই সন্ত্রাসী হামলা প্রতিহত করতে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত তিন ফ্রেঞ্চ কমান্ডোকে মক্কায় আনা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু নিয়ম অনুযায়ী, কোনো অমুসলিম মক্কায় প্রবেশ করতে পারে না, তাই তারা সাময়িকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে। তবে আরেকটি সূত্র অনুযায়ী, তারা কম্পাউন্ডের ভেতরে প্রবেশ করেনি, বরং পাকিস্তানি স্পেশাল ফোর্স প্রবেশ করেছিল।
উদ্ধার অভিযানের শুরুতে কয়েকবার আন্ডারগ্রাউন্ড সুড়ঙ্গ দিয়ে মিশনের চেষ্টা করা হয়। লুকিয়ে থাকা জায়গায় গ্রেনেড মেরে মেরে সন্ত্রাসীদের খোলা জায়গায় আনা হয়। এরপর মসজিদের ভেতরকার সকল পানির পাইপ খুলে দেওয়া হয় যেন কাবার ভেতরে বন্যার মতো হয়ে যায়। ফলে সন্ত্রাসীরা সিক্ত অবস্থায় পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর পুরো পানিকে ‘ইলেক্ট্রিফাই’ করা হয়। বাকিদের টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে কাবু করা হয়।
তবে এত সহজ ছিল না এই উদ্ধার অভিযান। টানা দুই সপ্তাহ লেগে যায় এই অভিযানে। অবশেষে বেঁচে থাকা সন্ত্রাসীরা সবাই আত্মসমর্পণ করে। আর এই দুই সপ্তাহ হারাম শরিফে কেন্দ্রীয় জামাতে কোনো নামাজ হয়নি, কাবা চত্বর ছিল ফাঁকা।
এ ঘটনায় মারা যায় ২৫৫ জন, আর আহত হয় ৫৬০ জন। সৌদির যৌথ বাহিনী থেকে মারা যায় ১২৭ জন। আর আহত হয় ৪৫১ জন। নিহত হয় তথাকথিত ইমাম মাহদিও। জুহাইমান আর তার ৬৭ অনুসারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে পরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
এ ঘটনার পরেই মূলত বর্তমান সৌদি রাষ্ট্রের আইন এখনকার মতো কঠোর অবস্থায় আসে। রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় নাগরিকদের ওপর। আর মৃত্যুর আগে জুহাইমানকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি কেন এটা করলেন। তিনি বলেছিলেন, একটি ভবিষ্যদ্বাণী ফলাতে পারলে বাকিগুলোও ঘটতে শুরু করবে। এটা ভেবেই তিনি এই কাজটা করেছিলেন।
সূত্র: The devastating 1979 siege of Mecca and the blood-thirsty Mahdi
ডিবিসি/আরপিকে